নিভৃত পল্লীর সেলিমের প্রিন্সিপাল হওয়ার গল্প

নিভৃত পল্লীর সেলিমের প্রিন্সিপাল হওয়ার গল্প
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২৩:০৯:৪২
নিভৃত পল্লীর সেলিমের  প্রিন্সিপাল হওয়ার গল্প
মো. মহসিন হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+
সেলিম হায়দার চৌধুরী। গোপালগঞ্জ জেলার এক নিভৃত পল্লীতে ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা. মো. আবদুল বারিক চৌধুরী, মাতা মাজু বিবি। গ্রাম: পশ্চিম নিজরা দক্ষিণপাড়া, উপজেলা. গোপালগঞ্জ সদর।লেখাপড়া শুরু দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর উলপুর পিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাস করেন। তখনো জানতেন না তিনি একদিন একটি কলেজের প্রিন্সিপালের মতো গুরু দায়িত্ব পালন করবেন। যার কথা বলছি তিনি খুলনা শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলনা পাবলিক কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল।
 
মঙ্গলবার দুপুরে খুলনা পাবলিক কলেজে নিজ কার্যালয়ে বিবার্তা২৪.নেটের বার্তা সম্পাদক মো.মহসিন হোসেনের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের গল্পে উঠে আসে তার জীবনের নানা ঘটনা। 
 
শুনুন তার মুখেই। বাবা মা ছিলেন অত্র অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত বংশের।  আমাদের এলাকায় তেমন রাস্তাঘাট ছিল না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বাড়ির কাছে থাকলেও উচ্চ বিদ্যালয়টি ছিল বাড়ি থেকে ২/৩ কিলোমিটার  দূরে। বছরের ২/৩ মাস শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেটে চলা যেত। বাকী সময় পানিতে ভরা থাকতো পুরো গ্রাম। নৌকায় করে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকতো না। স্কুলে যাওয়ার সময় গামছা পড়ে যেতাম। স্কুলের প্যান্ট ব্যাগে করে নিয়ে যেতাম। স্কুলে গিয়ে প্যান্ট পড়তাম। এভাবে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হতো। 
 
বিল এলাকার মানুষের এই কষ্ট এখন আর নেই। অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে। 
 
নিভৃত পল্লীর সেলিমের  প্রিন্সিপাল হওয়ার গল্প
হাইস্কুলে পড়ার সময় কোন শিক্ষক আপনাকে বেশি ভালবাসতেন, কার কাছ থেকে পড়াশুনায় বেশি সহযোগীতা পেয়েছেন। হাই স্কুলের লাহু স্যার ও দেবেন স্যার বেশি সহযোগীতা করেছেন। দেবেন স্যার ছিলেন অংকে জাহাজ। তাকে সবাই অংকে জাহাজ বলে ডাকতেন। 
 
আমরা কখনো প্রাইভেট পড়িনি। সমস্যা হলে স্যারদের কাছ থেকে শুনে নিতাম। 
 
আমাদের স্কুলের পাশে অনেক বাড়িতে আমগাছ ছিল। আমরা প্রায়ই পাশের বাড়ির গাছ থেকে আম পেড়ে খেতাম। স্কুলের পাশে হিন্দু বাড়িতে মন্দির ছিল। আমরা দল বেধে বন্ধুরা প্রায়ই ওই মন্দিরে যেতাম। সেখানে মন্দির থেকে আমাদের খাবারও খেতে দেয়া হতো। এসময় আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে জাকির, গিয়াস উদ্দিন, অমানান্দ, পরিমল ওদের কথা মনে আছে। জাকির এখন গোপালগঞ্জ জজকোর্টে পেশকার। গিয়াস উদ্দিন, অমানান্দ, পরিমল ওরা ব্যবসা করে।
 
হাই স্কুলে পড়াকালে চায়না নামের একটা মেয়ে ছিল। কখনো ও ক্লাসে ফার্স্ট হতো, কখনো আমি ফার্স্ট হতাম। একবার ইংরেজি কবিতার সারমর্ম লিখতে গিয়ে চায়নার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব হয়েছিল। চায়না বলে সে যেটা লিখেছে সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে। আমি বললাম আমি যেটা লিখেছি সেটা ভাল হবে। পরে হেড স্যার (সদর আলী) রায় দিলেন আমার লেখাটাই ভাল হয়েছিল। 
 
তখনকার দিনে স্কুল জীবনে আপনারা কিভাবে সময় কাটাতেন। স্কুলে যাওয়া আসা আর লেখা-পড়াই দিনের বেশিরভাগ সময় চলে যেত। তবে আমরা স্কুলের টিফিন টাইমে ফুটবল খেলতাম। তখন ক্রিকেট তেমন জনপ্রিয় হয়নি। ফুটবলই ছিল জনপ্রিয় খেলা। 
 
এসএসসি পাসের পর গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে ভর্তি হই। হাই স্কুল বাড়ি থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে হলেও কলেজ বাড়ি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ছিল। সেজন্য মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ শহরে ম্যাচে থাকতাম। আবার মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে কলেজে গিয়ে ক্লাস করতাম। যখন বাড়ি থেকে যেতাম তখন সকাল ৬টায় নৌকায় উঠতে হতো। প্রায় তিন ঘন্টার মতো লাগতো। একবার কলেজে যাওয়ার সময় দুই নৌকায় সংঘর্ষ ঘটে নৌকা ডুবে গিয়েছিল। 
 
ম্যাচে থাকাকালে একবার একটা ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনাটি এখনো মনে পড়ে। আমি একটা দোকানের ওপরে থাকতাম। একদিন আমার রুমের কলসের পানিতে কে যেন তামাকের গুড়া মিশিয়ে রেখেছিল। আমি বুঝতে পারিনি। রূমে এসে কলসের পানি পান করি। তখন তামাকের প্রতিক্রিয়ায় মাথা ঘুরতে থাকে। কয়েক ঘন্টা এভাবে কাটে। পরে ডাক্তারের কাছেও যাওয়া লাগে।
 
১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করি। তারপর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। 
 
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভর্তি হলেন, সেটা কার প্রেরণা বা কার সাহায্যে হয়েছিলেন। 
 
আমার একজন চাচাতো ভাই নাম জোবায়ের এনামুল কবির। তিনি তখন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন। ইকোনোমিক্স-এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আমি তার রূমে থেকেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেই। রাজনীতি ও সরকার বিভাগে ভর্তি হই। থাকতাম ওই ভাইয়ের রুমেই। মীর মশাররফ হোসেন হলের ২৫৯ নম্বর রুমে। জোবায়ের ভাই এখন বিপিএটিসি সাভারে কর্মরত। ওখান থেকে ১৯৮৬ সালে মাস্টার্স শেষ করি।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কোনো স্মরণীয় ঘটনা কী মনে পড়ে?
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে আমি ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলাম। অবশ্য সক্রিয় ছিলাম না। তখন এরশাদ ক্ষমতায় ছিল। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হতো। একদিন আমাদের হলের সব শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে মাঠে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। সারাদিন না খেয়ে মাঠে বসে ছিলাম। এটা সব সময় মনে পড়ে। 
 
৮৭ সালে পাবলিক কলেজে চাকরি হওয়ার আগে কোথাও কোনো চাকরি করেছেন কী?
 
হ্যাঁ, ইআরডির একটি প্রজেক্টে কয়েক বছর কাজ করেছিলাম। এক্সপার্টিয়েট কনসালটেন্ট নামের ওই প্রজেক্টে ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজ করি। আমার কর্মক্ষেত্র ছিল ঢাকার বিআইএম। 
 
পরে খুলনা পাবলিক কলেজে চাকরির আবেদন করি। এখানে প্রভাষক পদে চাকরি হয়ে যায়। ২৯ বছর ধরে এই কলেজেই আছি। 
 
প্রতিষ্ঠাকালে এই কলেজটির নাম ছিল সুন্দরবন বয়েজ পাবলিক স্কুল। পরে এর নাম হয় সুন্দরবন পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ। সর্বশেষ এটির নাম পরিবর্তন হয়ে এখন খুলনা পাবলিক কলেজ। আমি বর্তমানে এই কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্বে আছি। তবে  প্রভাতী শাখার ভাইস-প্রিন্সিপালের দায়িত্বে আছি দীর্ঘদিন ধরে। শিগগিরই নতুন প্রিন্সিপ্যাল জয়েন করবেন। 
 
এত দীর্ঘ সময় ধরে কলেজে চাকরি করছেন, এখনো অধ্যাপক কেন হতে পারলেন না?
 
হ্যাঁ ২০০৮ সালে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাই। তবে এরপর আর অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাইনি। ২০১১ সালে কলেজের বোর্ড অব গভর্নস মিটিং-এ চারটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টির জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত আর কার্যকর হয়নি। 
 
এই কলেজে কোনো অধ্যাপকের পদ নেই। যদিও ৭/ ৮জন সহযোগী অধ্যাপকের পদোন্নতি হওয়ার মতো যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু পদ সৃষ্টি না হওয়ায় তা হচ্ছে না। 
 
জীবনের শেষ প্রান্তে অধ্যাপক হওয়ার আশা করছেন কী?
 
অবশ্যই যারা শিক্ষকতা করেন তারা সবাই চান যে অধ্যাপক হবেন। আমারও সে আশা আছে। এখনো ৮ বছর চাকরির মেয়াদ আছে। আশা করি এই সময়ের মধ্যে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হবে, একই সঙ্গে আমরা যারা সিনিয়র আছি আমরাও পদন্নোতি পাব। 
অনেক কিছুইতো বললেন, পারিবারিক জীবনের কথা কিছু বলেন। 
 
আমি ১৯৮৬ সালে বিবাহ করি। আমার স্ত্রী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনোমিক্সের ছাত্রী। পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়। স্ত্রী সেলিনা সুলতানা বর্তমানে খুলনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। 
 
আমার তিনটি ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে সুমনা চৌধুরী ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বিএড অনার্স পড়ছে। ছেলে চৌধুরী তৌহিদ বিন হায়দার নাটোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশ আর্মি বিশ্ববিদ্যালয় অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজিতে প্রথম বর্ষের ছাত্র। আর ছোট মেয়ে সায়িমা চৌধুরী বয়রা মহিলা কলেজে হতে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। 
 
২৯ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমন কিছু কী মনে পড়ছে, যা পাঠকদের বলতে চান। 
 
আমরা শিক্ষকতা করি। আমাদেরতো কোনো সফলতা নেই। আমরা সারাজীবন শিক্ষার্থীদের পড়াই। তাদের মানুষ করি। আমাদের হাত থেকে শত শত শিক্ষার্থী বেরিয়ে যায়। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। এটাই আমাদের সফলতা।
আপনার ছাত্ররা বড় পদে আছে এমন কারো নাম মনে পড়ে কী?
 
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী থেকে শুরু করে বহু প্রতিষ্ঠানে আমাদের এই কলেজের শিক্ষার্থীরা রয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কুয়েটসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা করছে। এছাড়া ডাচ বাংলা ব্যাংকের আইটি বিভাগের প্রধান শাকিল আহমেদ, ঢাকা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু আমার ছাত্র ছিল। তাদের কথা মনে আছে। আরও অনেকের নাম এখন স্মরণ নেই। 
 
পাবলিক কলেজে এখন কতজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আছে?
 
এখানে বর্তমানে ৮৫ জন শিক্ষক ও তিন হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। একটি আবাসিক হল আছে। এখানে ১০০ শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা আছে। 
 
উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পাবলিক স্কুলের অনুকরণে সুন্দরবন বয়েজ পাবলিক স্কুল নামে স্কুলটি চালু করা হয়। একই বছরে কলেজ সেকশনের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের ১ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম করণ করা হয় খুলনা পাবলিক কলেজ। খুলনা মেট্রোপলিটন সিটির বয়রা এলাকায়  সবুজ গাছপালা বেষ্টিত মনোরম পরিবেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ একর জমির ওপর এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত। কলেজটি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।    
 
বিবার্তা/মহসিন
    
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com