সাম্প্রতিক বাংলা ভ্রমণসাহিত্যে মঈনুস সুলতান একটি বিশিষ্ট নাম। এ বাবদে তিনি ইতিমধ্যে গৌরবজনক বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে, তিনি নিজস্ব একটি গদ্যভঙ্গি তৈরি করেছেন, যা পড়লে লেখকের নাম ছাড়াই বুঝা যায় যে, এটি মঈনুস সুলতানের গদ্য। তাতে থাকে দেশি, বিদেশি ও আঞ্চলিক শব্দের নির্বিবাদ মিশেল। তার বর্ণনাভঙ্গিতে পাঠক চমকিত ও মুগ্ধ হবেন – এ আর এমন নতুন কী।
নতুন যা তা হলো তার নতুন বইটি। আকাশরাজ্য নামের বইটিতে লেখক আফ্রিকার ছোট দেশ লিসোটো, তার প্রকৃতি ও মানুষের বিচিত্র জীবনধারা ফুটিয়ে তুলেছেন তার অনবদ্য গদ্যে। এও নতুন কিছু নয়। নতুন যা তা হলো মঈনুস সুলতানের এবারের বইটি শুধু ভ্রমণকাহিনী থাকেনি, হয়ে উঠেছে এক অনাস্বাদিত অসম প্রেমের বিষন্নতায় ভরপুর এক কাহিনীকাব্য।
প্রেমকাহিনীর নায়িকাটি আমাদের, অর্থাৎ মঈনুস সুলতানের পাঠকদের, একেবারে অপরিচিতা নয়। এর আগেও লেখকের একাধিক বইতে তার নাম জেনেছি আমরা। অল্পবয়সী, চটুল, নৃত্যকুশল ও প্রেমপটিয়সী এই নারী একজন কবি। তার নাম নাকাতুলে। নিঃসঙ্গ লেখক কীভাবে যেন তাতে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে মেয়েটিকে তিনি বলেও ফেলেন, কে আ ও রাটা (বাংলায় : আই লাভ ইউ)। মেয়েটিও তাতে গররাজি নয়। তবে আফ্রিকান তরুণী কবি’র প্রেমবোধ ও অসমবয়সী বাংলাদেশী লেখকের প্রেমের প্রকার এক নয়। মেয়েটি লেখককে নির্দ্বিধায় বলে : কে আ ও রাটা। কিন্তু সাথে এও জানিয়ে দেয় যে, সে বহুগামী সমাজের সদস্য। লেসোটোর সমাজে বহুগামিতা বৈধ ও স্বীকৃত। কাজেই একই সঙ্গে তার রাখালবন্ধু এবং শ্বেতাঙ্গ পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গেও প্রেম ও কামে তার আপত্তি নেই। অতএব, লেখকের সঙ্গেও তার প্রেমের খেলা চলতে পারে। সে লেখকের কাছে নিজেকে সমর্পণেরও প্রস্তাব দেয়। কিন্তু লেখক এড়িয়ে যান।
একদিকে দুর্বার প্রেমের টান, অন্যদিকে বহুগামী সমাজের নিয়মরীতিতে প্রবল আপত্তি – এই টানাপোড়েনে ক্রমাগত রক্তাক্ত ও বিষন্ন হতে থাকেন অসমবয়সী প্রেমিক লেখক।
এই কাহিনী ফ্যাক্ট হোক কিংবা ফিকশন – মঈনুস সুলতান তাঁর পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন এক মেদুর বিষন্নতা। লেখকের শূণ্যতাবোধ ছড়িয়ে যেতে পেরেছে পাঠকের বুকের গহীনে। এবং প্রথমবারের মতো (তাই কি?) মঈনুস সুলতানের কোনো বইতে মৃত্যুচিন্তা দেখে চমকে উঠতে হয়।
মঈনুস সুলতানের গদ্যভাষা এমনিতেই আলাদা (সেটা শুরুতেই বলেছি), তার ওপর তাঁর এ বইটি তাঁর অন্যসব বইয়ের চাইতেও আলাদা। যদিও এতে লেসোটোর সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুরই দেখা মেলে। কিন্তু দ্বিধাচূর্ণ প্রেম এসে পুরো কাহিনীকে মেঘের বিষন্ন রঙে রাঙিয়ে দেয়।
মঈনুস সুলতানের গদ্য যেমন স্বচ্ছন্দ প্রবহমান, প্রথমা প্রকাশনের প্রতিটি বইও তেমনি সুসম্পাদিত। তবুও খটকা লাগে যখন ‘বলে’ শব্দটির ‘ভুল’ ব্যবহার দেখি। এটি প্রায়ই ‘নামের’ শব্দের বিকল্প হয়ে এসেছে।
কিন্তু কেন? লেখক হয়তো কলমের টানে লিখে গেছেন, কিন্তু সম্পাদকের সতর্কতাই এক্ষেত্রে কাম্য ছিল না কি?
আরো একটি বিষয়, লেখক তার অননুকরণীয় ভঙ্গিতে কিছুর বর্ণনা দিতে গিয়ে নানা তুলনা-প্রতিতুলনা ব্যবহার করেন। এতে দেখা যায়, ব্যক্তিবিশেষের চেহারা বর্ণনা করতে দিয়ে ব্যক্তিটিকে অকারণে হাস্যকর বানিয়ে ফেলা হয়। রুচিবান ও সংবেদনশীল পাঠকের কাছে এতে লেখকও কিছুটা খাটো হন বলে আমার ধারণা। লেখক হয়তো ভেবেচিন্তে কাউকে খাটো করতে চান না, হয়তো এটা তাঁর রচনার স্বতঃস্ফূর্ততারই ফল। তবু এ বিষয়ে লেখকের আরেকটু সতর্ক হওয়া ভালো বলেই মনে করি।
আরো কথা আছে, বইটিতে এতো সুন্দর-সব ছবি এসেছে, নাকাতুলের ছবি নেই কেন? তবে কি এ কেবলই কল্পনা?
দামী অফসেট পেপারে ছাপা ২৬০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য মাত্র ৩৩০ টাকা। যে-কোনো বিচারেই অসম প্রেমের এ বিষাদকাব্যটি বইপ্রেমী মানুষের অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি।