বর্ষার সজল টলমলে মুক্তোর মতো চকচকে পানি টিপটিপ করে কদম ফুলের ওপর আশীর্বাদ হয়ে ঝরছে আর যেন বলছে ‘হে বর্ষার রানী তুমি বিকশিত হও’, যৌবন ভরা গ্রাম্য কিশোরীর মতো তা-থৈ তা-থৈ নূপুর পায়ে রিনিক ঝিনিক নাচ, ফোঁটা ফোঁটা পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে প্রকৃতির অপরূপ কন্যা, স্রষ্টার অকৃত্রিম দান পুষ্পমঞ্জুরি থেকে। আর তা ঝরে পড়ছে ছোট ছোট পাতার ওপর, প্রতিটি ফোঁটায় সৃষ্টি করছে এক মধুর সঙ্গীত। হঠাৎ করে একমুঠো রোদ হেলেপড়া বিকালের ওই শেষ সীমানা থেকে উঁকি দিল আকাশে।
উন্মুক্ত উদার এই প্রকৃতির খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বিলাইছড়ি। হ্যাঁ বিলাইছড়ি, চট্টগ্রাম থেকে বাসে চেপে কাপ্তাই তারপর কাপ্তাই থেকে দেড় ঘণ্টার পথ, চলাচলের একমাত্র বাহন লঞ্চ। লঞ্চে করে আসার সময় প্রকৃতির অপূর্ব রূপ দেখে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। দু’পাশে পাহাড় ঘেরা, মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদী।
রোদের আলোয় চকচকে নদীর পানিতে চোখ রেখে মনে হবে যেন রূপকথার কোন জগতে বসে আছেন। প্রতিটি পাহাড়ের বুকজুড়ে সবুজের সমারোহ যেন সবুজের সমুদ্র। লঞ্চ থেকে নেমে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল, মনে পড়ে গেল উউলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা।
ঘন সবুজের মাঝে হারিয়ে বুঝতেই পারিনি কখন বিলাইছড়ি বাজারে পৌঁছে গেছি। চারদিকে নতুন মুখ, সবাই উপজাতি। তারা আমার দিকে সকৌতুকে চেয়ে রইল। এগিয়ে গিয়ে তাদের দু’তিন জনের সঙ্গে কথা বললাম, তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলল, অনেক কথা না বুঝলেও তাদের সঙ্গে একটা সখ্য গড়ে উঠল।
বাজার ঘুরে দেখতে চাইলে ঝিয়াং চাকমা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাল। বেশ সরু একটা জায়গায় দু’পাশ দিয়ে গাদাগাদি করে প্রত্যেকে তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। সমতার জায়গার অভাবে বাজারটা সংকুচিত হয়েছে। বেশকিছু নতুন সবজি ও ফলের সন্ধান পেলাম যেমন চিনাল, আমজুরি ইত্যাদি।
বাঁশের মধ্যে পাতা দই দেখে খেতে ইচ্ছা হল, সত্যিই অসাধারণ দই। বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে এলে কাঠের তৈরি ঝুলন্ত সেতু দেখে গা ছমছম করে উঠল, যদিও পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা দৌড়ে দৌড়ে সেতু পার হচ্ছে। সেতু পার হয়ে দেখলাম একদল পাহাড়ি মেয়ে হাতে দা, পিঠে টুকরি বেঁধে সারি সারি হেঁটে যাচ্ছে। ক
থা বলে জানলাম ওরা নীলপাহাড়ে যাচ্ছে কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করার জন্য। বলা বাহুল্য, পাহাড়ি মেয়েরা পুরুষদের থেকে বেশি পরিশ্রমী এবং সংসার চালানোর পুরো দায়িত্ব তাদের। প্রকৃতির এই নিবিড় সংস্পর্শে ভুলে গেলাম খাবারের কথা, অনেকটা পথ হাঁটার পর একটা হোটেল পেয়ে গেলাম। পাহাড়ের ওপর মাচা বানিয়ে বাঁশের চটা আর গোলপাতার তৈরি হোটেল।
হোটেলে বাঙালি খাবার ভাত-ডাল আর চ্যাপা শুঁটকি পেলাম, এমন একটা পরিবেশে এমন খাবার আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকবে। হোটেলের মালিক চমচমী মারমার কাছ থেকে যেনে নিলাম অনেক অজানা তথ্য পাহাড়ি জীবন সম্পর্কে, পাহাড়ের মানুষগুলো সহজসরল, শহরবাসীর মতো যন্ত্রমানব তারা এখনও হয়ে ওঠেনি।
অথবা প্রকৃতির এই নির্মল পরিবেশই বোধকরি তাদের এমন প্রাণবন্ত সতেজ আর সরল করে রেখেছে। কাপ্তাই যাওয়ার জন্য লঞ্চঘাটে ফেরার পথে চোখের দৃষ্টি আটকে গেল একটা পাহাড়ের দিকে। সবুজের মায়া জড়ানো পাহাড়ের গা-বেয়ে নামছে ঝরনার ফোয়ারা। প্রাণের রস জোগাতে কোথাও যদি আসতে হয়, তবে এই তার স্থান, বিলাইছড়ি।
এরকম শান্ত শীতল ঝরনার কাছে দাঁড়ালে তার ফিরে যেতে মন চাইবে না ইট-পাথরের ব্যস্ত ইমারতে। তবুও নিজেকে সংবরণ করে এগিয়ে চললাম লঞ্চঘাটের দিকে, যদিও থাকার মতো আবাসিক হোটেল আছে, তারপরও কর্তব্যের টানে মায়া ছাড়তে হল প্রকৃতির।
দু’পাশে পাহাড়ঘেরা পায়ের মধ্যখানে উঁচুনিচু পথ। মচমচ করে শুকনো গাছের পাতা পায়ের নিচে অবলীলায় মূর্ছনার সৃষ্টি করল। রাস্তার পাশ থেকে তুলে নিলাম টকটকে লাল পাহাড়ি ফুল। সবমিলে মন বলে উঠল কি প্রাণবন্ত অদ্ভুত সৌন্দর্যে ভরপুর এই বিলাইছড়ি।
বিকাল সাড়ে ৫টায় কাপ্তাইয়ের উদ্দেশে লঞ্চে চেপে বসলাম। কারণ ঘরে ফিরতে হবে জীবনের প্রয়োজনে। বিলাইছড়ি থেকে ফিরে এলাম যদিও কিন্তু প্রকৃতির সজল মায়া বুকজুড়ে রইল।
বিবার্তা/জিয়া