পাকিস্তানে দিন ফিরিয়ে অন্তত তার লাশ...

পাকিস্তানে দিন ফিরিয়ে অন্তত তার লাশ...
প্রকাশ : ১১ মে ২০১৬, ১৩:২১:০৪
পাকিস্তানে দিন ফিরিয়ে অন্তত তার লাশ...
মোমিন মেহেদী
প্রিন্ট অ-অ+
পাকিস্তানে দিন ফিরিয়ে তাদের ভাইদের লাশ
বাঙালি আর চায় না করতে যন্ত্রণায় হাশফাঁশ
কাদের-সাকা-মুজাহিদ আর নিজামীকে যেমন
ফাঁসি দিলেন বিচারপতি সাঈদীকেও তেমন
ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করুন এই
বাংলাদেশে শয়তান আর নষ্টদের ঠাঁই নেই
এই দেশতো শাহজালালের-শাহপরানের তৈরি
এমন দেশে স্বাধীনতা নিয়ে যারা বৈরি
তাদের হবে ফাঁসিরে ফাঁসি হবে তাদের
ষড়যন্ত্র-খুন-ধর্ষণ পথচলা যাদের...
 
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এভাবেই বরাবরের মত অবিরত সাহসের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে তারুণ্যের প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন নিরন্তর সত্য কথা। যে সত্য কথার সূত্র ধরে উঠে এসেছে- ‘ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না- যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সে কথাকেই প্রমাণ করেছে। এই যে মতিউর রহমান নিজামীর শাস্তি হলো, এটা তার প্রাপ্য ছিল। প্রকৃত অর্থেই মতিউর রহমান নিজামী যে যুদ্ধাপরাধ করেছেথ তার ক্ষমা নাই। তবে এ যাবৎ যে কজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তি কার্যকর হলো, তার মধ্যে নিজামীর বিচারটা ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তার অপরাধটাও ছিল বিশেষ ধরনের। কারণ, সে ছিল কুখ্যাত বদর বাহিনীর সংগঠক। 
 
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা যে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল, তা ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আর বাংলার নিরীহ নারীদের ওপর যে পাশবিক অত্যাচার তারা চালিত করেছে, এর চেয়ে জঘন্য আচরণ বাঙালি এর আগে দেখেনি।
 
১৯৭১ সালে গণহত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের সহযোগিতা করেছে এই স্থানীয় দোসররা। আমরা সেই হানাদারদের বিচার করতে পারিনি; কিন্তু তাদের দোসর এই স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকদের বিচার দেরিতে হলেও করতে পেরেছি। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার নমুনা বারবার এসেছে। ১৯৭১-এ বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের সাহায্য করে তারা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে- এটা সেই বিশ্বাসঘাতকতারই ধারাবাহিকতা। আর নিজামী সেই বিশ্বাসঘাতকদের অন্যতম।
 
বাঙালির কাছে তাই এই বিচার প্রত্যাশিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ, এত বড় অপরাধের বিচার না করতে পারলে জাতীয়ভাবে আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই আরও শক্ত, আরও সুবিধার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতাম। এ বিচার প্রতিহিংসা নয়- এটা ন্যায্য। ভবিষ্যতের জন্যও এটা বড় একটা দৃষ্টান্ত।’
 
এই দৃষ্টান্তকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দুরন্ত দুর্বার হয়ে বলতে চাই- আমাদের সোনার দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের লাশেরও স্থান নেই। কেননা, ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বলে যে, দেশের বিরোধীতাকারী কখনোই পুণ্যবান হতে পারে না। যেমন হতে পারেনি কাদের মোল্লা, সাঈদী, সাকা, মুজাহিদ, নিজামীসহ জামাতের অধিকাংশ নেতাকর্মীই। আর যেহেতু তারা পুণ্যবান নয়; সেহেতু তাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব ধর্ষণ-খুনের মত ঘটনার নেপথ্য বা সরাসরি নায়ক হিসেবে থাকা। যেমন অন্যায়ের নায়ক হিসেবে ব্যাপক অন্যায় আর অপরাধ করেছে জামাতি নেতা নিজামী। 
 
ইতিহাস অনুযায়ী তার অপরাধের চিত্র ঠিক এমন- পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আতাইকুলা থানার মাতপুর গ্রামের মাওলানা কছিমুদ্দিন স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন মাওলানা কছিমুদ্দিনকে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। 
 
একাত্তরের ১৪ মে নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদররা পাবনার ডেমরা, বাউসগাতি ও রূপসা গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর সাড়ে চার শতাধিক হিন্দুকে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে নারীদের ধর্ষণও করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মে মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপনের পর গোলাম আযম ও নিজামী সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। যার ফলে সারাদেশে অনেক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। 
 
নিজামীর নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় একাত্তরের ৮ মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে লোক জড়ো করে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ নির্বিচারে অসংখ্য লোককে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়। একাত্তরের ১৬ এপ্রিল ঈশ্বরদী থানার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৯ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। 
 
একাত্তরের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধূলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ৫২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে চারজনকে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সেখানে শাহজাহান আলীকে গলা কেটে ফেলে রাখা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। একাত্তরের ৩ নভেম্বর রাতে নিজামীর দেওয়া তথ্যে বেড়া থানার বিছাখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ সেলিমের বাবা আবদুস সোহরাবকে আটক করা হয়। নির্মম অত্যাচার চালানোর পর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে তাকে হত্যা করা হয়। 
 
মুক্তিযুদ্ধকালে ৩০ আগস্ট রাতে পুরনো এমপি হোস্টেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে বন্দি জালাল, রুমী, বদি, জুয়েল, আজাদসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যার নির্দেশ দেন নিজামী। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এরপর জালাল বাদে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। নিজামী ও রাজাকার বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রফুল্ল, মানু, ভাদু, স্বস্তি প্রামাণিক, জ্ঞানেন্দ্রনাথ হালদার ও পুতুলসহ ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। ৭০ বাড়িতে আগুন জ্বালানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে পাবনার সোনাতলা গ্রামের অনিলচন্দ্র কুন্ডু নিরাপত্তার জন্য সপরিবারে ভারতে চলে যান। পরে তিনি আগস্ট মাসে ফিরে আসেন। তার ও গ্রামের অন্যদের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। 
 
একাত্তরের ৩ আগস্ট নিজামী চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে শহর ছাত্র সংঘের এক সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেখানে পাকিস্তান রক্ষার পক্ষে বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র সংঘের সভাপতি আবু তাহের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার আদেশ দেন। নিজামী ওই সভায় নিজেও বক্তব্য রাখেন এবং আবু তাহেরের বক্তব্যের মৌন সম্মতি দেন। একাত্তরের ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল-মাদানী স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন নিজামী। 
 
এ সভায় দলীয় নেতাকর্মীদের স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এরপর তারা সারাদেশে সংঘটিত হয়ে অপরাধ করতে থাকে। এসব ঘটনার দায় নিজামীর ওপর বর্তায়। একাত্তরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন নিজামী। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় হিন্দুস্তানের মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদর সদস্যরা প্রস্তুত। মুক্তিকামী বাঙালিরা ভারতের সহযোগী। একাত্তরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডি হলে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় নিজামী তার বক্তব্যে জিহাদের সমর্থনে আল কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করে নিরীহ স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণকে হত্যার নির্দেশ দেন। 
 
একাত্তরের ৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজামী পাবনার সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্পে যাতায়াত করতেন। এ সময় তিনি রাজাকার কমান্ডার সামাদ মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের শলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।’
এছাড়াও অসংখ্য অপরাধের অপরাধী যেমন নিজামী, ঠিক একইভাবে সাঈদীও। তাহলে সাঈদীর কেন নিজামীর বিরুদ্ধে থাকা ষোলোটি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না?আমরা চাই সাঈদীরও ফাঁসির রায় দেয়া হোক। ক্রমশ সাহস আর স্বচ্ছতার রাস্তায় এগিয়ে যাক আওয়ামী লীগ। 
 
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেফতার করে যেমন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সাহসের পরিচয় দিয়েছিলো, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছিলো, ঠিক একইভাবে ফাঁসির রায় দিয়ে ও কার্যকর করে আরো উজ্জল করে তুললো ভবিষ্যত। তবে তার সাথে সাথে চাই সাঈদীর ফাঁসির রায়। চাই ট্রাইবুনালের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেন হয় সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি। পাশাপাশি সকল যুদ্ধাপরাধীর লাশ পাকিস্তান সরকারকে প্রদানেরও দাবী জানাচ্ছি। যাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত মাটিতে কোনভাবেই দাফন না হয় অবিরত অন্যায় আর অপরাধ করে চলা লোভী-লম্পট জামাত-শিবির নেতাদের...।
 
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
 
বিবার্তা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com