ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব দুষ্টু এক বালক, যার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা-মা স্কুল বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলোজি ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক। তবে মাস্টার্সের পাঠ চুকিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে।
প্রাণবন্ত এই মানুষটা বিবার্তাকে জানালেন তার দুষ্টুমিমাখা শৈশব-কৈশোরের কথা। আর বললেন তার আজকের মারজান হয়ে ওঠার গল্প।
জীবনের শুরুটা কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার ধারীশ্বর গ্রামে। অভিজাত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাড়ির নাম কেউ বলতেন সাহেব বাড়ি, কেউ বা বলতেন সাংবাদিক বাড়ি। বাবা পেশায় ব্যবসায়ী, দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। ব্যবসার জন্য বাবা থাকতেন ঢাকায়। ফলে বাবা-মায়ের শাসনমুক্ত হওয়ার সুবিধা পেয়ে ঘোড়ার পেছনে দৌঁড়ানো, চাষিদের সাথে মাঠে ধান কাটা, গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে হৈ-হুল্লোড় কোনোটাতেই বাদ যায়নি সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের শৈশব-কৈশোরে।
ছোটবেলায় ঘোড়ার পায়ে ঘুংগুরের আওয়াজ দূর থেকে পেলেই তিনি ছুটে বের হয়ে যেতেন বাড়ি থেকে। ঘোড়াচালক তাকে তুলে নিতেন চলন্ত অবস্থাতেই। বেশ কয়েক বার তিনি দুর্ঘটনারও শিকার হয়েছেন ঘোড়ার প্রতি নেশার কারণে। মা-দাদু দুশ্চিন্তায় থাকতেন এবার তাদের নাতি বা সন্তান কোন আঘাত নিয়ে আসে।
এদিকে মা-বাবার স্বপ্ন, বড় হয়ে দাদু অর্থাৎ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দীনের মতো বড় সাংবাদিক হবেন মারজান। মা চাইতেন, আমার সন্তান হবে অল রাউন্ডার। হবে একজন ভালো মানুষ ও নেতা। তাই মায়ের কাছ থেকে অবাধ স্বাধীনতা যাকে বলে তা তিনি পেয়েছেন।
এদিকে গ্রাম চষে বেড়ানোর সুখ বেশিদিন সহ্য হলো না এই দুষ্টু বালকের। সবে ক্লাস ওয়ান শেষ করেছেন, সেই সময় তার বাবা-মা তাকে এনে ভর্তি করিয়ে দিলেন রাজধানীর শাহজাহানপুরে অবস্থিত হিজবুল্লাহ প্রি ক্যাডেট স্কুলে। দ্বিতীয় শ্রেণী শেষ করার পর তাকে নিয়ে আসলেন বাসাবোর কদমতলা পূর্ব বাসাবো উচ্চ বিদ্যালয়ে।
দুষ্টুমি যতই করুক না কেন, পড়াশুনার বেলায় একদম ঠিকঠাক তিনি। তবে দুষ্টুমি বন্ধ হয়নি তখনও। সবসময় ক্লাসে রোল এক থেকে তিনের মধ্যেই থাকে। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়ে স্কাউটিংয়ে যোগ দেন। পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা করতেন কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার আসরে।
সেই সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা কনকর্ড বিমান দিয়ে। সেই আধুনিক বিমান দেখে তিনি জীবনের লক্ষ্য ঠিক করলেন বড় হয়ে কনকর্ড বিমান চালানোর।
এই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে মারজান বললেন, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করত মানুষ এত্ত বড় বিমান কিভাবে আকাশে ওড়ায় ? ঠিক করলাম, বড় হয়ে পাইলটই হব। কিন্তু ক্লাস নাইনে যখন বিভাগ ভাগ হয় তখন তার পাইলট হওয়ার ইচ্ছেটা কোথায় যেন উবে যায়।
বেছে নিলেন ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলেন। বাবা-মা-শিক্ষক সবাই খুশি। এবার কলেজে ভর্তির পালা। ভর্তি হলেন ঢাকা কমার্স কলেজে। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে এইচএসসির আগে স্থানান্তরিত হন ঢাকা বিজ্ঞান কলেজে।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু মেরিট লিস্টের ১১০০ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ছেলের নাম খুঁজে পেলেন না তার মা-বাবা। চান্স না পাওয়ায় তিনি নিজে যে কষ্ট পেয়েছেন, মা-বাবা তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন - জানালেন সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান।
‘চেষ্টা থাকলে সব করা সম্ভব’ নীতিতে বিশ্বাসী মারজান এবার দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। ফলস্বরূপ ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটে মেধা তালিকায় ১৬তম হন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন আর নিজের ভালো লাগা নিয়ে ভর্তি হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বিভাগের কাজে সব সময় ছিলেন সবার আগে সেটা নবীন বরণ হোক কিংবা অন্য কিছু। পড়াশোনার সাথে অন্যান্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইউথ ক্যাম্প ফর এশিয়াস ফিউচার ক্যাস্পের জন্য মনোনীত করেন। তার মেধা ও যোগ্যতার কারণে তাকে বাংলাদেশের দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাস নয় সদস্যের বাংলাদেশ দলের দলনেতা হিসেবে মনোনীত করেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েও মারজান সবার সেরা হলেন। ৩২২ জন প্রতিযোগীকে ছাপিয়ে তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগী। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে থেকেও সাফল্য নিয়ে আসলেন।
শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, এবার তার ইচ্ছে বাইরের জগতটাকেও জানার। নিজের ভালো লাগা আর নিজের পায়ে দাঁড়ানো দুইই হলো যখন অনার্স প্রথম বর্ষেই সাংবাদিকতা শুরু করলেন ঐতিহ্যবাহী দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায়। ২০০৬ সাল থেকে টানা তিন বছর সেখানেই সাংবাদিকতা করলেন।
এরপর ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দৈনিক ‘কালের কণ্ঠে’ ফিচার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। ২০১১ সালে ৭১ টিভিতে সাংবাদিকতা শুরু করলেন। একই সাথে ‘বিবিসি বাংলা’ বিভাগে খণ্ডকালীন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন ছয় বছর। পাশাপাশি পড়াশুনাও চলছিল সমান তালে। অনার্স আর মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
এরপর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ২০ মাস। এবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলোজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরই মধ্যে তার ১৩টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মূলত ভালো লাগার জায়গা ও পেশা - দুটোকে একসাথে করে এগুতে চান সৈয়দ মারজান। পরবর্তীতে ক্রিমিনোলোজি, সাংবাদিকতা নিয়েই গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে বলে জানালেন এই তরুণ প্রভাষক।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নিজের চাওয়ার জায়গায় যদি কেউ সৎ থাকে, পৃথিবীতে কোনো কাজই অসাধ্য নয়। তার বাস্তব প্রমাণ আমি নিজেই। শুধু সময়ের কাজটা সময়ে করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমি সংগ্রামী সেই সব ছেলে মেয়েদের স্যালুট করি, যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে, নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে চায়।
বিবার্তা/রুবা/মৌসুমী/কাফী