বিশ্বে পর্যটন-ব্যক্তিত্বদের কথা উঠলে শীর্ষ কাতারে প্রফেসর ডেভিড সিমন্সের নামও থাকবে। আগাগোড়া পর্যটনমনস্ক এই প্রফেসর নিউজিল্যান্ডের লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন স্টাডিজে বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর তিনি সেখানে কাজ করেছেন।
পরে ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ‘অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল গভর্নমেন্টস সাসটেইনেবল ট্যুরিজম কোঅপারেটিভ রিসার্চ সেন্টার’র গবেষণা পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তিনি বিষয়বস্তু নকশা এবং টেকসই পর্যটন অনলাইন গবেষণা পোর্টালের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন।
বর্তমানে তাঁর গবেষণার মূল বিষয় পর্যটন নীতিমালা ও পরিকল্পনা। এছাড়া পর্যটন খাতে অর্থনৈতিক ও টেকসই উন্নয়নের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করা।
ডেভিড কম্বোডিয়া (ডব্লিউডব্লিউএফ), মরিশাস (ইউএনডিপি), নিউয়ে, ভানুয়াতু (ডব্লিউটিও/ইউএনডিপি), নেপাল (এমএফএটি এবং ডব্লিউডব্লিউএফ), ভারত (ডব্লিউডব্লিউএফ), সারাওয়াক (ই. মালয়েশিয়া), এবং ডিপিআর উত্তর কোরিয়ায় (জাতিসংঘের/ডব্লিউটিও) পর্যটন পরিকল্পনা বিষয়ে কাজ করেছেন।
বরেণ্য এই পর্যটন বিশেষজ্ঞ চলতি মাসের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশে এসেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকা। রবিবার ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে তার সাথে বাংলাদেশের পর্যটনের বিভিন্ন সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন বিবার্তা২৪.নেট-এর সহ-সম্পাদক ইয়াসীন হোসেন পাভেল।এখানে তার সারাংশ তুলে ধরা হলো-
বিবার্তা: বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক খাতগুলোর অন্যতম পর্যটন। এর মূল কারণ কী?
ডেভিড সিমন্স: বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শিল্পে যখন রুগ্নদশা দেখা যাচ্ছে, তখনই বিশ্বব্যাপী দ্রুত সম্প্রসারণশীল বহুমাত্রিক শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে পর্যটন শিল্পের। এ মুহূর্তে পর্যটন হচ্ছে সারা বিশ্বের অন্যতম বিকাশমান খাত। বেড়ানো বা ভ্রমণকে মানুষ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাই দিনে দিনে পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে সারা বিশ্বে।
জন্মগতভাবেই মানুষ কৌতূহল প্রবণ এবং সে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াতে চায়। পাশাপাশি বিশ্বে প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটেছে, তাই মানুষের আয় এবং ব্যায়ের ক্ষমতাও বেড়েছে।এক সময় ভ্রমণের বিষয়টিকে অনেকে ব্যয়বহুল মনে করলেও মানুষ এখন সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
বিবার্তা: ৯ এপ্রিল আপনি বাংলাদেশে এসেছেন। ইতোমধ্যে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং এখানকার পর্যটন কেন্দ্রগুলো দেখেছেন। বাংলাদেশ বা এর পর্যটন সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
ডেভিড সিমন্স: হ্যা, আমি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তবে এর মধ্যে আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে এদেশের মানুষের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার। এখানকার সবাই সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব সম্পন্ন। যা সত্যিই অনেক ইতিবাচক। এখানকার আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যটক অনেক। এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে বাঙালিরা তাদের দেশকে ভালোবাসে।
এদেশে আন্তর্জাতিক পর্যটক আসছে। তবে সেটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। এই সংখ্যাটা বাড়াতে এদেশের পর্যটন ব্যবস্থাপনাকে আরও ভালো করতে হবে। পর্যটকদের সুযোগ -সুবিধা, নিরাপত্তার বিষয়ে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।
বিবার্তা: কক্সবাজার বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। এর মাধ্যমে আমরা কীভাবে বিদেশি পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করতে পারি?
ডেভিড সিমন্স: কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত। তবে বিশ্বে আরও অনেক সমুদ্র সৈকত আছে এবং সেগুলোতে অসংখ্য পর্যটক যাচ্ছেন। এখন সেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হলে এখানকার কর্তৃপক্ষকে অনেক সচেতনতার সাথে উদ্যেগ নিতে হবে।
প্রথমত সৈকতে প্রাকৃতির সৌন্দর্যের পাশপাশি সুন্দর করে সাজাতে হবে। সব সময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ভালো কেনা-কাটার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে খেলাধূলা এবং বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যটকদেরকে ধরে রাখার মতো বা আকৃষ্ট করার মতো পর্যাপ্ত ব্যব্স্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিতো আছেই। মূল কথা হচ্ছে এটা যেমন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৈকত তেমনি অন্যান্য সুযোগ সুবিধাতেও সবচেয়ে ভালো হতে হবে। তবেই মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হবে, এখানে বেড়াতে আসবে।
বিবার্তা: বাংলাদেশের পর্যটন খাতের ইতিবাচক দিকগুলো কী?
ডেভিড সিমনস: আমি আগেই বলেছি বাংলাদেশের সর্বত্র আমি অতিথিপরায়ণতা দেখেছি। এখানকার মানুষ খুবই সাহায্যপ্রবণ এবং আমার মনে হয়েছে তারা সত্যিই তাদের দেশের উন্নতি চায়। তাই তারাই এদেশের প্রধান শক্তি। পাশাপাশি বাঙালিদের বিভিন্ন উৎসব-সংস্কৃতি রয়েছে এবং সেগুলোতে তারা প্রাণভরে আনন্দ করে। যেমন আমি শনিবার পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিলাম। সেখানে সম্ভবত জল-উৎসব চলছিল। সে উৎসবে আমি তাদেরকে প্রাণভরে আনন্দ করতে দেখেছি। সত্যিই এত প্রাণোচ্ছলতার সাথে উৎসব পালন করার বিষয়টি আমি বিশ্বের অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তারা সত্যিই আনন্দ উপভোগ করতে জানে।
বিবার্তা: বাংলাদেশের পর্যটন খাতের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?
ডেভিড সিমন্স: এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পর্যটনের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সময়োপযোগী ও পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা। এটা করতে পারলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। পর্যটকদের পরিবহনের জন্য উন্নতমানের ট্যুরিস্ট বাস, কোচ, ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যটন শিল্পের প্রসারে কিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যেই তিনি ‘চ্যাম্পিয়ান অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ভালো দিক।
বিবার্তা: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বাংলাদেশে আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হোক।
ডেভিড সিমন্স: বিবার্তাকেও ধন্যবাদ।
বিবার্তা/পাভেল/কাফী