ক্লান্ত পতিতা

ক্লান্ত পতিতা
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০১৬, ০৯:৫৪:২৪
ক্লান্ত পতিতা
আলবার্তো মোরাভিয়া, অনুবাদ জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+
মারিয়ার চোখ দুটির সহজ-সরল অনুবাদ কেউ কি করে দেবেন? না থাক, ওটা এখন চোখের লোনাজলে ভেজা! কিন্তু মারিয়া তো কাঁদে না। তার নির্বাক চেয়ে থাকাই যে কান্নার চেয়ে সকরুণ!
 
দরজা ভেজানোই ছিল। বাহুর আলতো ধাক্কায় খুলে গেল, ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই যুবকটার চোখ গেঁথে গেল মারিয়ার দিকে। শান্ত এবং সমাহিত। অথচ দুর্বোধ্য হাজারো জিজ্ঞাসা ওই চোখ দুটিতে খেলে যায়। 
 
রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় যুবকটি কল্পনার তুলিতে মারিয়ার দেহের ফিগার মেপে নিয়েছে। বুড়িই তো বলা যায় মারিয়াকে। চিমসানো বুক, থলথলে পেট, হাত ও পায়ের পেশিতে টান টান ভাব এখন অতীত দিনের স্মৃতি। থাইগুলো নিশ্চয় বেঢপ সাইজের হয়ে গেছে।  
 
মারিয়ার কাছে টাকা এখন সোনার হরিণ। পরিচিত খদ্দেররা ভিন গলিতে ঢুঁ মারছে। খালি পকেটেই এ ধাচের মাগীর কাছেই যাওয়া চলে। পড়ন্ত বেলায় মাগীর দেহে কতটুকুই বা তেজ থাকে?
 
যুবকটি এখন ডিভানের নরম গদিতে বসে আগাগোড়া ভাবছে। হিসেব যে তার মিলছে না। নিবিড় আদরে তার হাঁটু জড়িয়ে বসে আছে মারিয়া। অথচ বেশিক্ষণ এখানে টিকতে পারবে, এ ভরসা তার ছিল না। ‘মারিয়া আমি তোমাকে শুধু এটাই বলতে এসেছিলাম... কথা কটি এখন যে শেষ করা যাবে না।’ 
 
দিন গড়ায় পুবের আকাশে রাঙামুখো সূর্যটা রুটিনমাফিক ফের উঁকি দেয়। নতুন নতুন সতেজ ইচ্ছের ডানা গজায় যুবকটির কল্পনার আকাশে। মারিয়ার নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকালেই কানে বাজে হায় ঈশ্বর! কী উল্টোটাই না আমি ভেবেছিলাম মারিয়ার রূপ-যৌবন আর বৈভব নিয়ে। বাস্তবতার নিক্তিতে মাপলে সে অর্থে মারিয়া এখনো তাকে পুরোটাই গ্রাস করতে পারেনি। 
 
‘না, আমার ধারণা কী বিশ্রী রকম কাঁচা ছিল’ যুবকটি ভেবে যায় আনমনে।  
 
মারিয়ার মাথায় একটা ধবধবে সাদা ও নরম কাপড়। দেখতে অনেকটা পাগড়ির মতো লাগছে। ডিম্বাকার মুখে তখনো মেকাপের নিপুণ কারুকাজ লেপ্টে আছে। ক্লান্ত অবসন্ন মুষ্টিযোদ্ধার মতো গায়ে জড়িয়েছে আরেকটি কাপড়। কিন্তু দেহের ভাঁজ তাতে আর কতটুকুই বা ঢাকা পড়েছে?
 
অথচ ভাড়াটে প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে যুবকটি পৌঢ়ত্ব আর টগবগে যৌবনের ব্যবধানটুকু আজ ভুলে গেছে। 
ভাবছে, দিন-ক্ষণ-মাসই কি জীবনের সবটুকু? দেহের উত্তাপ থিতু হয়ে আসতেই একটা অস্বস্তি ঘিরে ফেলে যুবকটিকে। মনে মনে ভাবে নাহ্,... এখানে আর আসবো না। এটাই আখেরি দেখা। কিন্তু মারিয়ার আগ্রাসী আর আবেগমাখা আলিঙনে চিন্তায় ছেদ পড়ে। 
 
মারিয়াকে সে কতটুকু ভালোবাসে তা সে কখনো মুখ ফুটে বলেনি। কিন্তু মন বলছে, একজন নারীকে যতটুকু ভালোবাসা যায়, মারিয়াকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসা উচিত। 
 
সময়ের ধারালো চাকু ওই রূপলাবণ্যে দাগ বসাবে, বসাচ্ছেও। কিন্তু কাছে পেলেই যুবকটির অস্থির হাত দুটি মারিয়ার দেহের প্রতিটি অলিগলিতে ছুটে বেড়ায় এক অজানা মুগ্ধ আবেশে। 
 
সব চলার শেষ আছে। এ আকর্ষণও একদিন ঢিলে হয়ে যাবে। কিন্তু হাঁটু জাবড়ে ধরা মারিয়ার মাংশল বুকের উমের আবেদনটাই যে আলাদা! 
 
যুবকটি বুঝতে পারে, ভরা যৌবনে মারিয়ার এক চিলতে বাঁকা অপাঙ চাহনির জন্য হাজারো আশেক লবেজান ছিল। পৃথিবী ঘোরার ভৌগোলিক সত্যিটা ওর ফিগারের দিকে তখন এক পলক তাকালেই টের পাওয়া যেতো। 
 
তা হোকগে। যুবকটি ভাবছে, বাস্তবতা হচ্ছে মারিয়ার এখন পড়ন্ত বেলা। সে তো সেই বৃদ্ধা বারবণিতা, যে নিজেকে নিরন্তর সুন্দরী হিসেবে উপস্থাপনে ব্যস্ত। কিন্তু সোফায় গা এগিয়ে বসে থাকা মারিয়ার দিকে তাকাতেই নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যুবকটি। কী করে থুতনি ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে রূপ ও যৌবনের বন্যা! অন্য কারো হাতে এতো ছিমছাম রূপের ডালি নিষ্পেষিত হোক আদিম আক্রোশে, তা সে কিছুতেই কামনা করতে পারে না। অবাধ্য মনটা বার বার শিশু হয়ে উঠে। 
 
কিন্তু পা-টা এক সময় মাটিতেই ঠেকে। মোহ ফিকে হয় আসে। 
‘যাবার সময় তো হল’- যুবকটি বলে ‘ড্রেস পরে নাও লক্ষ্মীটি।’ 
 
মুখে কিছু না বললেও মারিয়ার চাহনিই বলে দিচ্ছে না বাপু ড্রেসট্রেস পরতে পারবো না। বরং আজ বাসায় যাব। একটু থেমে আবার বললো, ‘আজ তোমাকে কিছু বলার আছে ডার্লিং।’ 
 
মারিয়ার মুখে মিটি মিটি হাসি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নিজের উপর আস্থাটি বেশ গাঢ়তর। এ ধরনের রহস্যময় হাসির দ্যুতি ছড়িয়েই কি সে তার প্রেমিকদের মুখের ভাষা আর আপত্তিকে চাপা দেয়? 
 
‘না’-কে এক পলকে হ্যাঁ বানানোর জন্য মারিয়ার একটু হাসিই কি যথেষ্ট? ওই হাসির সম্মোহনী শক্তিটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে?  
 
যুবকটি রীতিমতো ভড়কে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামনে নিয়ে জানতে চায়, গুরুতর কিছু ঘটেছে কিনা। 
 
ইতস্তততা চাপা দিয়ে মারিয়া শান্ত কণ্ঠে জানাল, ‘একটা গুরুত্বপূর্ণ কল আসতে পারে, এমনটাই প্রত্যাশা করছি।’ 
 
পাল্টা কিছু বলার আগেই টেলিফোন বেজে উঠলো। 
যুবকটি ভাবতেই পারছে না, মারিয়া কিভাবে ভাবতে পারলো যে, এখনই টেলিফোনটা বেজে উঠবে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো তার কপালে। 
 
‘কে টেলিফোন করেছে? কে হতে পারে’? টেলিফোনের অপর প্রান্তের পরিচয় জানতে চায় উৎসুক যুবক। 
 
‘কেউ না, একজন লোক। আমাকে এক সময় বেশ আপন করে নিয়েছিল’Ñ কোন প্রকার ভণিতা ছাড়াই মারিয়া জবাব দেয়। 
 
‘কবেকার কথা বলছ?’
‘সে অনেক আগের কথা’, শান্ত কণ্ঠে মারিয়া বলে, ‘তবে গত পরশু ফের দেখা পেলাম। ঠিকই চিনলাম। আমাকেও চিনলো। ও বেশ বুড়িয়ে গেছে। তবে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সটা যে বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে,  তা সহজেই ঠাওর করা যায়। মারিয়া এক নিঃশ্বাস সাবেক প্রেমিকের বয়ান ঝাড়লো। অযৌক্তিক হিংসা অথবা ব্যাখ্যাহীন মানসিক চাপে শেষের কথাগুলো যুবক শুনলেও বুঝতে পারেনি। হয়তো বোঝার ইচ্ছে তার নেই। 
 
যুবকটির মনে হল, মারিয়ার বয়স হঠাৎ করেই উবে গেছে। সে এখন গর্বোদ্ধত যৌবনের ডাহা তরুণী। হাসি যে তার থামতেই চায় না। 
 
দেহে লেপ্টে থাকা গোলাপি র্যা পারটি অবাধ্য হয়ে বার বার খসে পড়ছে। কী নিঃসীম মাদকতা মারিয়ার চোখে-মুখে! 
 
লোকটি ওর রূপে পাগল না হয়ে যাবে কই? কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে একটা প্রশ্ন বারবার মাথা চাড়া উঠছে ‘লোকটা কি তার চেয়েও মারিয়াকে বেশি ভালবাসতো? মারিয়া তার জীবনের শেষ নাকি শুরু?’
 
দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে এলো। বড্ড বেদরদী শব্দে দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। অথচ মারিয়া কখন যে তার রুমে চলে গেছে তা খেয়ালই করতে পারেনি। 
 
এ মারিয়াকে সে কি কখনো দেখেছে? মোটেও না। ওর আবেগ ঝরা আর সেবাযতেœ নতুন বউয়ের আমেজই সব সময় যুবকটি খুঁজে পেয়েছে। এসব কথা ভাবতেই সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে উঠে। 
 
কী মধুর স্বরেই না মারিয়া বলতো ‘ডার্লিং কতটুকু চিনি হলে কফিটা তোমার মনের মতো হবে’, তখন পরিমাণটা না বলে মারিয়াকে বুকে চেপে ধরার ইচ্ছে জাগতো। 
চা বানাতে গিয়ে আর হাতের কাছে এগিয়ে দিতে গিয়ে মারিয়ার দেহ কিভাবে মোহময় ভঙ্গিতে বাঁক নিতো সবই তার চোখে ভাসছে। 
 
আগুনের তাপ যেমন করে কাপড়ের আর্দ্রতা শুষে নেয়, ঠিক তেমন করে যুবকটির যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর অনভ্যস্ততা গ্রাস করে নিতো মারিয়া।
 
আজও চা সাজিয়েছে মারিয়া। ওটা খেতে খেতেই সন্ধ্যা নামলো। গোধূলির আবছা আলো বাইরে। ঘরে আলো-আধাঁরি। দুজনেই চুপচাপ। খালি কাপের দিকে দুজনের চোখ গেঁথে রয়েছে। নীরবতাই তাদের একমাত্র ভাষা। 
 
মারিয়া হঠাৎ উঠে সুইচ অন করে টেলিফোনের সামনে বসলো। তার কণ্ঠে এখন ডাহা তারুণ্য, প্রাচীন কোন অন্ধকার গুহা ভেদ করে তার কণ্ঠ ইথারে ইথারে আছড়ে পড়ছে। আর হাসির ঝলকে মনে হয় পাঁচ টাকার কয়েকটি কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে উঠছে।
 
যুবকটির অস্থিরতা তখন চরমে। নোটিশ ছাড়া উঠে দাঁড়িয়ে মারিয়ার রুমে ঢুকলো। 
এক কোণে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে একটি ফাইল কেবিনেট। যুবকটি অনেকটা আনমনে কেবিনেটের ড্রয়ার খুলে ফেললো। নিরাসক্ত চোখে ড্রয়ারের জিনিসপত্রের দিক নজর বুলাচ্ছে। 
 
খেলা শেষে তাসগুলি যেমন করে অগোছানো ভাবে পড়ে থাকে, ড্রয়ারের জিনিসপত্রের অবস্থাও তেমন পরিপাটিহীন। 
 
হঠাৎ সে এক গোছা বিবর্ণ ফটো হাতে নিলো। বুঝতে বাকি রইল না, এরাই তার পূর্বসূরী, মারিয়ার সাবেক খদ্দের। ওদের মিছিলটা বেশ বড়ই। 
 
ভাবলেশহীন চোখে মারিয়া সব কিছু দেখছে। মুখে কোন শব্দ নেই। চেহারায় নেই বিরুক্তি। 
 
এটাই যুবকটির কাছে অসহ্য ঠেকলো। মনে হলো, তার রক্তঝরা আঘাতগুলো মারিয়ার নীরবতায় স্টিলের মোটা সুঁচের মত বীভৎস কায়দায় তার দেহের প্রতিটি বিন্দুতে ভয়ানকভাবে দেবে যাচ্ছে। 
 
মনে মনে বললো মারিয়ার এতোটা চুপচাপ থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। মারিয়া দৌড়ে এসে কেন যে ছবিগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছে না। 
 
মনে হল, সে নয়, প্রাণহীণ ছবিগুলোই তার দিকেই সেভাবে তাকিয়ে আছে, যেভাবে দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তিপ্রাপ্ত আসামীরা বাইরের পৃথিবীর আকাশটাকে বারবার দেখতে থাকে। 
 
এভাবে স্মৃতি নামের পুরনো আপদকে মারিয়া কেন যে কেবিনেটের কোটরে বন্দি করে রাখতে গেল? 
এখন ছবিগুলো প্রাণ ফিরে পেলেই বিবর্ণ অতীত থেকে মারিয়াকে আর পৃথক করা যাবে না। কারণ ছবির মানুষগুলো গর্বোদ্ধত যৌবন নিয়েই জেগে উঠবে। 
 
হতভাগা যুবকটি কিনা সেই ছবিগুলোই তার হাতে চেপে রেখেছে। শুধু ছবি হলে আপত্তির তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ছবির ব্যানারে জেগে উঠছে হারানো সময়, রক্ত মাংসের এক দঙ্গল মানুষ। তারা এক বাক্যে মারিয়ার বিরুদ্ধে অবিচারের অভিযোগ তুলছে, সমস্বরে। 
কিন্তু কেন এ অভিযোগ? মারিয়া তো এখন বিগত যৌবনা। অথচ সাক্ষী, বিচারক, এজলাস ভর্তি হরেক জাতের মানুষ সবাই হাজির হয়ে গেছে, বিচার শুরু হতে বাকি নেই!
 
উত্তরহীন হাজারো প্রশ্ন যুবকটির মস্তিষ্কের কোষে কোষে দাপাদাপি করছে। 
বন্দি মারিয়াকে জেরা করা হচ্ছে। 
তুমি কি এ লোকটাকে চেন? তোমার আঠার বসন্তে তোমার সাথে লোকটার পরিচয় কিভাবে হয়েছিল? তোমার মাথার চুল নিশ্চয় পরিপাটি কওে আঁচড়ানো ছিল। লোকটার গলা ও থুতনিতে হাত বুলোতেই কি তোমার যৌবনের প্রতিটি রক্তকণিকায় আগুন লেগে গেছে? আর এতেই অন্তর্বাসটি কি নিমেষেই ঝরে পড়লো শেমিজের ফাঁক গলে। 
 
যুবকটি কল্পনার চোখে দেখছে, স্কার্টের ঘেরের ভেতর মারিয়ার কম্পমান দেহটা বাঁক খাচ্ছে। পা দুটি কষে ঝাড়া দিতেই হাই হিল গায়েব। যেমন করে কাফে-কনসার্টের ফুলের মাদকতা আর তামাকের ধোঁয়ার মাঝে নর্তকী ছান্দিক গতিতে তার পায়ের কালো মোজা উধাও করে দেয়। 
 
তুমি আঠারো বছরের হৃদয় কাঁপানো সুন্দরী! চিবুকে মেকাপের লেশমাত্র নেই, ওটা এমনিতেই গলদা চিংড়ির মতো লাল হয়ে গেছে হৃদয়ের উত্তাপে। 
লজ্জার ফাঁপড়িগুলো মুহূর্তেই ফুটালো রক্তলাল গোলাপ কুঁড়ি। ঠোঁটে লিপস্টিক না মাখলেও ওটা ছিল সত্যিকারের আকর্ষণীয় ও উজ্জ্বল, সবাইকে চুম্বকের মতো টানছে। চোখে আইব্রাশটাও বুলোতে হয়নি। ঝিলের স্বচ্ছ জলের মতো নিস্তরঙ্গ চোখ দুটি ছিল নিষ্পাপ। হ্যাঁ কিছুটা উদ্বেগ তাতে ঝিলিক মারছে। মোহন ভঙ্গিতেই তুমি এ লোকটার সাথে উদ্দাম নেচেছিলে। ওই লোকটার ব্যাপারে তুমিই বল। ওই লোকটাকেও বাদ রেখো না। 
 
উহ! নীরবতার ভাষা কী বীভৎস! 
এ অখ- নীরবতাই যেন পরিস্থিতি অনুবাদ করে দিচ্ছে। যুবকটি যেন কয়েকটি ছবি হাতে নিয়ে মারিয়াকে দেখিয়ে নাম-ঠিকানা আর পরিচয় পর্বের প্রেক্ষাপট বলার জন্য বেজায় চাপ দিচ্ছে। 
 
যেন এসব প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই নিহিত রয়েছে ফাঁসির আসামি মারিয়ার বেঁচে যাওয়াটা। অথচ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও মারিয়া দিব্যি নির্বিকার। বিবর্ণ ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে অতীত হাতড়ে মারিয়া বলতে বাধ্য হচ্ছে, ইনি হচ্ছেন অ্যাডাম। অভিনেতা ছিলেন। এখন সিনেমা জগতেই চাকরি খুঁজে নিয়েছেন। 
 
ইনি একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, যুদ্ধে মারা যান। পরের জন মিস্টার স্মিথ, একজন ব্যাঙ্কার। সম্ভবত বেঁচে নেই।
সবার শেষে যুবকটি একজন মোটা মানুষের পরিচয় জানতে চায়। ডিনার জ্যাকেট পরা এ লোকটা। ভ্রুযুগল ভীষণ চরড়া। কে এই কুমড়োপটাশ? ওয়েটার নাকি? 
এই প্রথমবারের মতো সব অনীহা আর উদাসীনতা ভেঙে মারিয়ার চোখে মুখে নির্ভেজাল দরদ উথলে উঠলো। 
 
বললো, তিনি ছিলেন একজন বিজনেস ম্যাগনেট, মিলানের। অতৃপ্ত বাসনা তাড়িত কণ্ঠে বলে উঠে মারিয়া, ‘উনি সবচেয়ে মালদার ছিলেন তিনি। আমাকে একটি ভিলা দান করেছেন।’ 
‘সত্যি দারুণ এক ভিলা’- মারিয়ার কণ্ঠে স্বপ্নমাখা মোহনীয় আবেগ। চোখ দুটি খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে গেছে ‘দোতলা ভিলা। সামনেই রয়েছে একটি দুর্দান্ত বাগান’ সাবেক এ বাসভবনের একটা বিস্তারিত বর্ণনা ঝাড়লো সে, ইটপাথরও বাদ রাখেনি। 
একটু জিরুনোর পর সে নিজে নিজেই বলে উঠলো ‘হ্যাঁ ঠিকই তো, যে পরিমাণ উপহার তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম, তা রাখতে পারলে আমিও এ শহরের ধনীদের একজন থাকতে পারতাম।’
 
যুবকটির মুখ কোন কথাই সরলো না। ভাবলো,  এতো কিছু থাকার পরও মারিয়া কেন তা ধরে রাখতে পারলো না। তার অনুতাপ্ত হওয়া উচিত। খেয়াল করে দেখলো মারিয়া বিড় বিড় করে বলছে ‘এসব ঘটনা এখন অতীতের এবং দুঃখের।’ 
বিচার পর্ব শেষ। আসামির কি বলার কিছুই নেই? সে কি কিছুই বলবে না? 
 
ফাঁসির রায় এলো, রায়টি মারিয়ার অল্পতে বুড়িয়ে যাওয়ার জন্য। মাংসপেশিতে বলিরেখা ফুটে ওঠার জন্য। চুলগুলো বাদামি হয়ে যাবার জন্য। আবেগ হারিয়ে ফেলা ও ঝলমলে অতীত স্মৃতি মনের কোণে বন্দি করে রাখার অপরাধে! 
 
সবই তো তার ছিল। একাধিক বাড়ি, গণ্ডায় গণ্ডায় প্রেমিক, পার্টি, জাঁকালো পোশাক আর হাসির ফোয়ারা। 
অথচ মারিয়া কিনা ডুবে গেছে ছাইগাদার মাঝে যেমন করে সমুদ্রের জাহাজগুলি রাতের সূচিভেদ্য আঁধারে এক সময় দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায়। 
 
যুবকটি ফের ফাইল কেবিনেট নেড়ে চেড়ে দেখছে। 
কয়েকটা জাপানি ছবির অশ্লীল নির্বিকারত্ব ঢাকা পড়েছে ধর্মীয় আচার-সর্বস্বতার দৃষ্টিকোণ থেকে। 
সমুদ্রবন্দর আর কানাগলির মোড়ে পাওয়া যায়, এমন কয়েকটি পর্ণোগ্রাফিরও অস্তিত্ব রয়েছে কেবিনেটে, যেসব তারকারা এক সময় উন্মাদ, ধ্বংস, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আর মনোবৈকল্যের শিকার হয়েছেন। হরেক পোজে এসব ছবি তোলা। 
 
সব শেষে মিললো কয়েক বান্ডিল প্রেমপত্র। ফিতায় বাঁধা, তবে ফিতাগুলি এখন বিবর্ণ। 
চিঠির কালি বিবর্ণ হলেও পড়তে অসুবিধে হচ্ছে না। 
 
হয়তো এসব চিঠি কোনদিনই আলোর মুখ দেখেনি। হয়তো মারিয়া পড়ার অবসর করে উঠতে পারেনি। 
অবশ্য এসব জিনিস যুবকটির মনে দাগ কাটেনি। বরং তার চোখ গেঁথে গেছে একটি খুদে রিভলবারের দিকে। বডি নিকেল করা স্টিলের, দামি মুক্তো বসানো। 
 
‘এটা এখানে কেন? আমি যে হিসাব মিলাতে পারছি না।
‘আত্মরক্ষার জন্য’ মাজল সরাতে সরাতে অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিল মারিয়া। যুবকটি কৌতুক করে রিভলবারটি তাক করেছিল মারিয়ার কপাল বরাবর।
 
‘যাগ্গে’ বেশ তৃপ্তির সাথেই কয়েক মুহূর্ত পর মারিয়া বললো ‘আমার মরণ যে ভয়ানক কায়দায় ঘটবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ভয়ানক কায়দারও একটা সরেস বর্ণনা ঝাড়লো এক নিঃশ্বাসে। 
প্রেমিক খদ্দের আর রিভলবারের দিকে তাকাতে তাকাতে সে এসব কথা বললো। 
চোখে ভীতির চিহ্ন নেই বরং তা চকচক করছে। মনে হচ্ছে সে মৃত্যুকে ডেকে আনতে চায়। 
এবার মারিয়া নিজের সম্পর্কে না বলে বন্ধুর কাহিনী তুললো। বছর দুয়েক আগে সে অস্বাভাবিক কায়দায় নিহত হয়। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল অভিবাদন কায়দায়। 
 
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমি চাই একই কায়দায় এ জ্বালা-যন্ত্রণার পাগলা গারদকে জানাতে চাই গুডবাই। 
যুবকটি হাসি চাপতে পারলো না ‘কি অদ্ভুত পরিকল্পনা তোমার।’ রিভলবারটি কেবিনেটে চালান দিয়ে মারিয়ার পাশে এসে বসে কোমর জড়িয়ে ধরলো। 
 
নিশ্চয়তার সুরেই জানানো, না মারিয়ার মৃত্যু অস্বাভাবিক কায়দায় মোটেও হবে না। মারিয়া মরবে বৃদ্ধ বয়সে রোগে ভোগার পর। বিশ্রী কায়দায় মরার ধারণটি তার মুছে ফেলা উচিত মন থেকে। কারণ এ জাতীয় মৃত্যু কেবল ফিল্মেই ঘটে। 
 
সান্ত¡না পর্ব শেষে যুবকটি বুকে জড়াতে চাইলেও মারিয়া তাকে দৃঢ়তার সাথে সরিয়ে দিল। তবে নিজের বিরক্তি বুঝাতে চাইল না। 
 
‘তুমি ধীরে ধীরে পশু হয়ে যাচ্ছ’ বিড় বিড় করে সে বলে কনিয়াকের বোতল ও গ্লাস নিয়ে হাজির।
‘বৃদ্ধাবস্থা ও একাকীত্বই তোমার মরণ ডেকে আনবে’ যুবকটি তার ভবিষ্যদ্বাণী আবার ছুঁড়ে দিল খানিকটা নিস্তেজ কণ্ঠে। 
উৎকট উদাসীতায় ঘাড় শ্রাগ করে নিচের ঠোঁটে সিগারেট ঝুলাতে ঝুলাতে মারিয়া কনিয়াকের বোতলের কর্ক খুলে গ্লাসে ঢাললো। এ সময় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠলো। 
‘কে বলছেন? মদের গ্লাস রেখে রিসিভার কানে লাগিয়ে জানতে চাইল মারিয়া। 
 
‘ওহ্’ শব্দটি উচ্চারণ করলো, তাতে হতাশা সুস্পষ্ট। তারপর শুধু নীরবে শুনে যাচ্ছে। 
এক সময় বললো, আপনি বলতে চাইছেন যে তার সাথে আমার কথা হবে না। মাত্র এক মিনিট কথা বলতে পারলেই হবে, লাইনটা দিন না প্লিজ। 
অনুরোধটা ফের জানালেও হতাশ হয়ে রিসিভার রেখে দিল। 
‘যাকে চাইলে তাকে পেলে? যুবকটি শুধোয়। 
 
প্রশ্নের ধরনে সে যুবকটির দিকে এমনভাবে তাকালো যেন এই প্রথম তাকে দেখেছে। তবে মুখে কিছুই বললো না। 
তার মদের গদ্বাসের পুরোটা এখনো খালি হয়নি। এক চুমুকে তলানিতে নামিয়ে এনে বললো ‘আমি এখন উঠবো। রাতের খাবার সারতে হবে।’ কথা না বলেই তারা ধোঁয়ায় ঠাসা রুম ছেড়ে পা বাড়ালো ডাইনিংয়ের দিকে। 
 
অন্ধকার করিডোর দিয়ে এগুনোর কালে মারিয়ার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে এনে যুবকটি চুমু খেল। প্রতিদানে পাল্টা চুমু প্রত্যাশা করলেও তা আর হল না। অথচ মারিয়া অতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে অভ্যস্ত। একবার যুবকটির মনে হলো, সম্ভবত মারিয়ার পা টলছে। অথচ কিচেনে ঢুকে সে ঠিকমতোই স্টোভ জ্বালালো। 
 
এই প্রথম তারা ফ্ল্যাটে একসাথে খেল। মারিয়ার কিচেন কতোটা সমৃদ্ধ ও পণ্যে ঠাসা, তা যুবকটি কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল হয়তো রেস্তোঁরা থেকে ঠা-া খাবার আনিয়ে নিয়েছে। 
মারিয়া কিভাবে এ ধরনের খানা পাকানো রপ্ত করেছে, তা ভেবেই সে হয়রান। কিচেনটি এতই গোছানো ও পরিপাটি যে, মনে হয় এটা আগে কেউ ব্যবহার করেনি। 
ডিনারের সময় তার ফ্ল্যাটে বাতি নেভানো থাকে। তাকে সে সব সময় বাইরেই রাতের খাবার খেতে দেখেছে। ফ্ল্যাটে চাকরবাকরও নেই। 
 
চোখ ধাঁধানো ধবধবে সাদা কিচেনে কর্মতৎপর মারিয়াকে আবিষ্কার করতে পেরে যুবকটির বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। 
অখ- মনোযোগে মারিয়া কাজ করছে। এক্কেবারে পাকা রাঁধুনি। কিচেনের ঠিক মাঝখানটাতে একটি বাতি ঝুলছে। বাতির আলো কিচেনের সাদা মার্বেলের ওপর ঠিকরে পড়ছে। সাদা আলোর বন্যায় ওদের দুজনকে মর্গের মৃতদেহই ঠেকছে। 
সব কিছু ছাপিয়ে একটি সত্যি তার মনে উঁকি মারছে ‘আরে এতো সেই নারী যায়, যাকে সে ভালবাসে।’ 
 
কিন্তু মারিয়া নির্বিকার। খানা তৈরির পর ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের সুযোগ্য গিন্নিপনার গর্বের উত্তাপ ছড়াচ্ছে। 
একে অন্যের দিকে না তাকিয়েই তারা খানা পর্বের পাঠ চুকালো। খানার শেষ দিকে যুবকটি জানালো ‘এতোটা নিপাট দক্ষতায় রাঁধতে দেখে এটাই মনে হয়েছে রান্না ছাড়া জীবনে আর কোন কর্মই তুমি শেখোনি।’ 
‘আমি জীবনে অনেক কিছুই করেছি’ - উত্তাপ ছাড়াই নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল মারিয়া। 
দেহের ঋজুতায় আলোয়ানটি আরেক দফা খসে পড়ল আর যুবকটি দেখল মারিয়ার স্তনদুটি কেঁপে কেঁপে দুলছে, যেন ও দুটির মাঝে যান্ত্রিক কায়দায় আলাদা প্রাণ ঠেসে দেওয়া হয়েছে। 
 
আবার নীরবতা নামলো রুমটাতে। 
পরিষ্কার ন্যাপকিনে মুখ মুছে তা উদোম হাঁটুর ওপর রাখতে রাখতে এবার নীরবতা ভাঙলো মারিয়া। 
‘টেলিফোনে যে ভদ্রলোকের সাথে আমি কথা বলেছি, তাকে আমি ভীষণ ভালবাসতাম। সত্যি বলতে কি, সেই আমার প্রথম প্রেমিক। আমার বয়স তখন সবে ষোল ছুঁয়েছে।’ 
 
এটা শোনার পর যুবকটির মনের আবার হিংসেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তবে এবার তার সাথে যুক্ত হয়েছে তিক্ততা আর একাকীত্বের আবহ। ভাবছে, সত্যিই তো, খেলতো, বেড়াতো, ভালবাসতো, নাচতো, জীবনের সোনাঝরা দিনগুলিকে সে ছুটিয়ে উপভোগ করতো। আর পড়ন্ত বেলায় সে অবিশ্বস্ত আঙ্গুলের ডগায় বেঁচে থাকার আকুল প্রত্যাশায় স্রেফ রুটি আঁকড়ে আছে, বেশ ক্লান্ত মনে হয় তাকে। 
 
‘তার অঢেল পয়সা’ মারিয়া বলে যায়, কিন্তু আমাকে একটি টাকাও দিতো না। 
যুবকটি তার প্রতিক্রিয়ার ধরন মাপার চেষ্টা করছে। তার মন সায় দিল, ‘মারিয়ার দুঃখ তোমার হৃদয় ছুঁয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু সেতো জানে না ভাগ্যের অদেখা পৃষ্ঠাগুলোতে তার জন্য আর কি অপেক্ষা করছে।’ 
‘তোমার কি টাকা পয়সার অভাব রয়েছে?’ এবার সে জিজ্ঞেস করলো বেশ ভদ্র কায়দায়। 
মারিয়া শ্লেষমাখা কণ্ঠে বেশ জোরেই জানালো, আমার কি টাকার দরকার নেই? অবশ্যই দরকার। 
 
‘কিন্তু কি কারণে দরকার?’ যুবকটি জানতে চাইল, ‘জামা কাপড় কিনতে নাকি সফর করতে? 
‘না’  দৃঢ়তার সাথে মারিয়ার জবাব, ‘শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে পালাতে।’
হাজারো লোকের ভিড়ে কারুকাজহীন কায়দায় সে বাঁচতে চায় না। ছোট্ট একটি শহরে সে একাই থাকতে চায়। 
‘যেখানে জন্মেছ সেখানে থাকতে চাইছ না কেন?’ যুবকটি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। 
 
মাথাটা কাত করে উদোম কাঁধের কাছে টেনে এনে বললো, ‘ছোট্ট একটা বাড়িতে একাকী থাকতে চাই। যেখানে থাকবে কয়েকটি রুম, সামনে বাগান।’ 
যুবকটির চোখে মুখে অবজ্ঞার হাসি, ‘কি বললে একটা বাগানও থাকবে’?
শান্তকণ্ঠে মারিয়ার জবাব ‘হ্যাঁ, বাগান, তাতে ফুটবে হরেক রঙের ফুল। কিন্তু টাকাটা যে আমি পাচ্ছিনে। হায়! বাড়ি আর বাগান ছাড়াই জীবনের বাকি সময়টুকু পার করতে হবে এবং একাকী।’
 
রাতের খানাপর্ব শেষে মারিয়া তার বিছানায় ঘুমাতে যাবে, এমন ধারণা যুবকটি আগ থেকেই করছিল। আসলে মারিয়ার জন্য ঘুমটা খুবই জরুরি। ও ঘুমাক। আরামসে ঘুমাক। 
গত দু’মাসের বেশি সময় ধরে যুবকটি মারিয়ার সাথে রয়েছে। এখন তার পকেট একেবারেই গড়ের মাঠ। মারিয়াকে ত্যাগ করা ছাড়া তার গতি নেই। 
 
গা থেকে মারিয়ার হাত-পা সরাতে গিয়ে বুঝতে পারলো মেয়েটি সত্যিই কাঁদছে। এতোটা অন্ধকারে চোখের জল দেখা সম্ভব নয়। 
শব্দহীন কান্না। তাই চোখের জল নীরবে ঝরছে যেমন করে ক্ষতস্থান রক্ত নীরবেই গড়িয়ে পড়ে। 
কান্নার কারণ জানতে চাইল। জবাব পেল না। আসলে ব্যাপার তা নয়, যা নিয়ে যুবকটি ভাবছে। মারিয়া ভাবছে শুধু ওই টেলিফোনটির কথা ভেবে। তারপর ও বললো ‘নাতো আমার কিছুই হয়নি’। 
 
ক্ষণিক বিরতির পর চোখ বন্ধ করে মারিয়া বেশ তিক্ততার সাথে নিজে নিজেই বল, ‘জীবনকে নতুন করে শুরু করাটা সত্যিই কঠিন।’ 
যুবকটি ভেবে পেল না কি জবাব দেওয়া যায়। মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘর জুড়ে অসহ্য নীরবতা। যেন মারিয়ার নির্বাক চাহনি চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে ‘কই আমি তো কেন কথাই বলিনি।’ 
 
নিজের শোনা ও দেখার ক্ষমতার উপর যুবকটির আস্থা কমে গেল। অথচ মারিয়ার কান্নাঝরা মুখ আর নাড়িছেঁড়া গোঙানি আরেকটি বার উপভোগ করতে চায় সে। 
মারিয়ার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো সে আসলে নিজের অস্তিত্বের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ক্ষণকালের জন্য নিজেকে খুঁজে পেল, কথা বললো। ফের নীরবতা। ফের সেই বাতচিত। নিজের সাথে, নিজের সত্তার সাথে। 
 
কিন্তু এ আত্মপ্রসাদের আয়ুর দৈর্ঘ্য বেশ ছোট। উঠে বাথরুম পর্ব সেরে সব দ্বিধাদ্ব›দ্ধ আর পিছুটান পেছনে ফেলে বেশ খানিকটা জোরে বলে উঠলো ‘গুডবাই মারিয়া।  আমি গেলাম।’ 
‘কাল আবার দেখা হবে’ চোখ না খুলেই মারিয়া বললো। 
যুবকটি একে একে রুম ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে নেমে গেটের কাছে চলে এলো। 
হঠাৎ সে থামলো। কাছের চার্চের ঘণ্টা বেজে উঠলো রাতের নীরবতা ভেঙে। না, সময় খুব একটা হয়নি। মাত্র সাড়ে দশটা। ভাবলো কোনো সিনেমা হলে ঢুকলোই আরো দুটি ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। 
 
ভাবনাটি তার মনে ধরলো। অথচ বুঝতেই পারছে না এ উটকো ভাবনাটি মাথায় কেন ঢুকলো। সে সিনেমার গাঢ় অন্ধকার দৃশ্যাবলীর সাথে একাকার হয়ে নিষ্ঠুর জাগতিকতা থেকে নিজেকে সযত্নে লুকিয়ে রাখতে চায়। মারিয়ার সাথে থেকে দোযখের উম আর নয়। গেট লাগিয়েই সে ছুটে চলে সিটি সেন্টারের দিকে, একাকী।
 
বিবার্তা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com