জিলিপি শব্দটি বেশ পয়মন্ত

জিলিপি শব্দটি বেশ পয়মন্ত
প্রকাশ : ০৫ মে ২০১৬, ১২:৪১:০৭
জিলিপি শব্দটি বেশ পয়মন্ত
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, হিন্দি জলেবি বা জিলেবী থেকে বাংলায় জিলাপি হয়েছে। কথ্য ভাষায় জিলিপি বলা হয়। মধ্যযুগের ভারতে এটা ‘জলভেল্লিকা’ ও ‘কুণ্ডলিকা’ নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে এটা ধীরে ধীরে জলেবি, জিলেবী নাম পায়। আর এ জলেবি ও জিলেবী থেকে পরে বাংলায় জিলাপি, জিলেপি শব্দ দুটি এসেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে এটা সামগ্রিকভাবে জলেবিয়া নামে পরিচিত। তবে মিসর, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে এটা জেলাবিয়া (zalabia) বা জালাবিয়া (zalabiya) নামে পরিচিত। আবার আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া ও মরক্কোয় এটার নাম জলেবিয়া (zlebia) বা জলাবিয়া (zlebia) বা জিলিবিয়া (zlebia)। আর মালদ্বীপে এটার নাম জিলিবি (zilebi)।

মাসকলাই ডালের চূর্ণ ও ময়দার গোলার মধ্যে সামান্য খামির মিলিয়ে ফুটন্ত ঘি বা তেলের মধ্যে কু-লাকারে প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে ফেলে ভেজে যে মিঠাই চিনির রসের মধ্যে ডোবানো হয়, তাই জিলাপি।

জিলিপি শব্দটি বেশ পয়মন্ত। কারণ হিন্দি জলেবি থেকে উদ্ভূত এ শব্দটি তার আদি চরিত্র বজায় রাখতে পেরেছে। হিন্দি জলেবি বা জিলেবী এসেছে ফারসি ‘জলব’ থেকে। এর মানে গোল হতে হতে বা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলতে থাকা।

জিলাপি বাংলাদেশের একটা জনপ্রিয় মিষ্টি যা প্যাচ বিশিষ্ট বা কুণ্ডলাকার। আর বাংলায় এ মিষ্টান্নের প্যাঁচটিও প্রবাদে পরিণত হয়েছে। নারীর মোহনীয় খোঁপার সঙ্গে জিলাপির তুলনা এসেছে বারবার। হরিচরণের অভিধানে অমৃতাগ্রন্থাবলীর প্রথম ভাগের রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে ‘জিলিপি রকমের খোঁপা’। বোঝা যাচ্ছে, জিলাপি নামের মিষ্টান্ন একেবারে নতুন নয়, বেশ বয়সী।

জিলাপির প্যাঁচ বা ফের দিয়ে মিষ্টান্নটির প্যাঁচের মতো মনের কুটিলতা বোঝানো হয়। প্যারিচাঁদ মিত্র তার ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যে সকল লোক জিলিপীর ফেরে চলে, তাহারা নানা কথা বলে।’

শুধু তাই নয়, জিলাপি এখন বলিউডেও জায়গা করে নিয়েছে। মল্লিকা শেরাওয়াত তার ‘ডাবল ধামাল’ ছবিতে আইটেম গান ‘জলেবি বাই’ গেয়ে সাড়া জাগিয়েছেন।

সুকুমার রায়ের ‘দাশুর কীর্তি’ গল্পে রয়েছে ‘ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি।’

জিলিপি কথ্য ভাষা, মান্য বাংলায় জিলাপি। বাংলায় জিলেপি, জিলেবি, জিলাবি ইত্যাদি বানান পাওয়াও দুস্কর নয়। ভারতীয় ভাষায় শব্দটি পাওয়া যায় ১৫ শতকের দিকে, তার আগে নয়। হবসন-জবসনে বানান jelaubee। আর ব্যুৎপত্তিতে বলা আছে, সম্ভবত আরবির জালাবিয়া বা ফারসির জলেবিয়া থেকে আগত। মিষ্টান্নটির হিস্পানি নাম zalabia, ফরাসিতেও তাই।

জিলাপির মূল উপাদান ময়দা, জাফরান, ঘি অথবা তেল ও চিনি। চিনির সিরাপে কেউ কেউ সাইট্রিক অ্যাসিড বা লেবুর রস, গোলাপ জল অথবা কেওড়ার জল মেশান। আকর্ষণীয় ঘ্রাণের জন্য তেজপাতা ও এলাচও মেশানো হয়।
 
মজার ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানের কোনো কোনো অঞ্চলে মাথাব্যথা সারানোর পথ্য হিসেবে জিলাপি ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে তারা জিলাপিকে শুরুতেই ফুটন্ত দুধে ভিজিয়ে রাখে আধ ঘণ্টা।

মধ্যপ্রাচ্যের এ খাবারটি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও ইরানেও বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের মিলাদে এটা হট আইটেম। রমজান মাসে ইফতারেও এটি একটি জনপ্রিয় খাবার। ইরানে এ মিষ্টান্ন রমজান মাসে গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
 
জিলাপির সর্বাধিক পুরনো লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদীর লিখিত ১৩ শতাব্দীর রান্নার বইতে। যদিও মিসরের ইহুদিরা এর আগেই খাবারটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল।

নেপালে এটা ‘জিরি’ নামে পরিচিত। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে নেপালিরা জিলাপির নাম রাখে জিরি। বোঝাই যাচ্ছে, জিলাপি ভারতের আদি মিষ্টান্ন নয়। এটা মুসলমানদের হাত ধরে ভারতে এসেছে।

আতঙ্কের খবর হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশে মচমচে জিলাপি, চানাচুর, ঝুরিসহ নানা সুস্বাদু খাবার ভাজা হয় পোড়া মবিল দিয়ে। পোড়া মবিল দিয়ে চানাচুর ভাজার হাজারও কাহিনী ছাপা হয়েছে পত্রিকা-সাময়িকীতে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েও সুফল পায়নি। সম্ভবত তাদের আবেদন কোনো জিলাপির প্যাঁচে আটকে আছে।

তারচেয়ে এক গল্প শুনুন…

এক লোক তার দোকানে জিলাপি বানাচ্ছিল। একজন উৎসুক পথচারী ও ক্রেতা জানতে চাইলেন কতদিন ধরে তিনি জিলাপি বানাচ্ছেন।

দোকানির জবাব ‘ত্রিশ বছর ধরে।’

পথচারী অবজ্ঞার সুরে বলল ‘বুঝতে পারছি ত্রিশ বছর চেষ্টা করেও সোজা জিলাপি বানাতে শেখেননি।’

বিবার্তা/জিয়া/নিশি
 

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com