আবারও ভূমিকম্প

আবারও ভূমিকম্প
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০১৬, ০১:১০:১৪
আবারও ভূমিকম্প
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল
প্রিন্ট অ-অ+

১.
নতুন বছরের জানুয়ারির ৪ তারিখ খুব ভোরবেলা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের ঘুম ভেঙে গেছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) যেহেতু সিলেট এলাকা থেকে বেশ কাছে ছিল তাই ঝাঁকুনিটা আমরা টের পেয়েছি সবচেয়ে বেশি। ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের ভেতর বাড়াবাড়ি এক ধরনের আতঙ্ক আছে। এই দেশে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে বছরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ মারা যায়, ভূমিকম্পে সাড়ে আটজনও মারা যায় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ গাড়িতে উঠতে কখনো ভয় পায় না কিন্তু ভূমিকম্পের বিন্দুমাত্র আভাস পেলেই ভয়ে আতঙ্কে তাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। আমি যতোটুকু জানি এই ভূমিকম্পে বাংলাদেশে যতো মানুষ মারা গেছেন তারা কেউ ভূমিকম্পের কারণে মারা যাননি, তারা মারা গেছেন ভূমিকম্পের ভয়াবহ আতঙ্কে। ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষজন চারতলা বাসা থেকে নিচে লাফ দেয়।

ভূমিকম্পের পরপর আমার সঙ্গে অনেকে যোগাযোগ করেছে। একজন লিখেছে, যখন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে তখন তারা ভয়ে-আতঙ্কে খাঁচার ভেতর আটকে পড়া ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি করেছে, কিন্তু কী করতে হবে বুঝতে পারেনি। আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন তাদের বলে দিই কী করতে হবে!

মুশকিল হচ্ছে আমি মোটেও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ নই, ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে সে ব্যাপারে আমার উপদেশ দেওয়া ঠিক হবে না। সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের সেই কথাগুলো বলা উচিত। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো আমাদের দেশে বড় বড় বিশেষজ্ঞ ভয় দেখাতে ভালবাসেন। ভূমিকম্পের সময় টিকে থাকার প্রথম বিষয়টাই হচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখা। ভয় পেলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায় না, কাজেই ভূমিকম্প নিয়ে অযৌক্তিক ভয়টা দূর করে ফেলতে পারলেই অনেক কাজ হবে। আমি বেশ কয়েক বছর ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্প এলাকায় ছিলাম। সেখানে সাল এন্ড্রিয়াস ফল্ট লাইনে যে কোনো মুহূর্তে একটা ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার কথা। আমি যখন থেকে এর কথা জেনেছি তারপর পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে, এখনো সেই ভূমিকম্পটি হয়নি। (হলিউডের লোকজন অবশ্য সেই ভূমিকম্পটিকে নিয়ে একটা সিনেমা বানিয়ে টুপাইস কামিয়ে নিয়েছে!) কাজেই ভূমিকম্পের প্রথম কথাটাই হচ্ছে এটি কখন হবে কেউ বলতে পারে না অর্থাৎ এটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো একটা বিষয় নয়! যেটা কখন আসবে কেউ জানে না সেটাকে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকার কোনো অর্থ নেই। হঠাৎ চলে এলে সেটাকে সামলানোর একটা প্রস্তুতি নিয়ে দৈনন্দিন কাজ করে যেতে হয়।

তবে সমস্যা হচ্ছে আমরা যদি বলতে থাকি ‘ভূমিকম্পের সময় কেউ ভয় পাবে না, মাথা ঠাণ্ডা রাখবে’ তাহলেই সবাই ভয় না পেয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে শুরু করবে সেটা কখনো ঘটবে না। আমি নিজে যখন জীবনের প্রথম বড় ভূমিকম্প দেখেছি তখন ভয় না পেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ছিলাম সেটা মোটেও সত্যি নয়। ভূমিকম্প নিয়ে পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত আমার ভয় একটু কমেছে।

পড়াশোনা করে আমি যেসব জেনেছি সেগুলো জানলে আমার ধারণা অন্যদেরও অযৌক্তিক ভয় একটুখানি হলেও কমবে।

প্রথমেই সবার যে বিষয়টা জানা দরকার সেটা হচ্ছে ভূমিকম্প কিন্তু খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এই লেখাটি লেখার জন্য আমি গত সপ্তাহে সারা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সবগুলো ভূমিকম্পের হিসাব নিয়েছি, মোট সংখ্যা হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার! অর্থাৎ ঘণ্টায় দশটা। যে বিষয়টা ছয়-সাত মিনিটে একবার ঘটে সেটাকে যদি আমরা নিত্যনৈমিত্তিক এবং খুবই স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মেনে না নিই তাহলে কেমন করে চলবে? কেউ যেন আমাকে অবিশ্বাস করতে না পারে সে জন্য পৃথিবীর ম্যাপে কোথায় কোথায় ভূমিকম্পগুলো ঘটেছে তার একটা ছবি দিয়ে দিচ্ছি। যার মনে অবিশ্বাস সে ইচ্ছে করলে গুনে দেখতে পারে। শুধু মনে রাখতে হবে এখানে ছোট-বড় সব রকম ভূমিকম্প আছে। এই সপ্তাহে নর্থ কোরিয়া তাদের হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়েছিল, সেটাও এখানে আছে! কারও যদি আরেকটু কৌতূহল থাকে তাহলে মনে করিয়ে দেওয়া যায় পৃথিবীতে রিখটার স্কেলে আট মাত্রায় (ভয়ঙ্কর) ভূমিকম্প হয় আনুমানিকভাবে বছরে একবার। সাত মাত্রার (বড়) ভূমিকম্প বছরে দশবার, ছয় মাত্রার (শক্তিশালি) একশোবার এবং পাঁচ মাত্রার (মাঝারি) হাজারবার। অর্থাৎ মাত্রা এক ধাপ কমে গেলে সংখ্যা বেড়ে যায় দশগুণ।

যারা ভূমিকম্পের ম্যাপটি প্রথমবার দেখেছে তারা নিঃসন্দেহে একটা বিষয় দেখে খুব অবাক হবে। পৃথিবীতে এত ভূমিকম্প হয় কিন্তু সেটি মোটেও সারা পৃথিবীতে সমানভাবে ছড়ানো ছিটানো নয়, নিশ্চিতভাবেই কোনো কোনো এলাকায় বেশি। যেখানে বেশি সেখানে ভূমিকম্পগুলো একটা লাইন ধরে সারিবদ্ধভাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমরা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে সেটাকে যতই একটা স্থির ভূখণ্ড ভাবি না কেন, আসলে এটা মোটেও স্থির নয়। পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ অনেকগুলো ভূখণ্ডে ভাগ হয়ে আছে এবং একেকটা ভূখণ্ড একেকদিকে যাচ্ছে। ভূখণ্ডগুলো যে জায়গায় একটা আরেকটাকে ধাক্কা দেয় আমরা সেগুলোকে বলি ফল্ট লাইন এবং সেখানেই ভূমিকম্প হয় সবচেয়ে বেশি।

আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কেউ এতোটুকু পড়ে এলে নিশ্চিতভাবে জানতে চাইবে বাংলাদেশ কী কোনো বড় ফল্ট লাইনের ওপর বসে আছে? উত্তর হচ্ছে ‘না’, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল্ট লাইন সেটা ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরোপিয়ান প্লেটের ধাক্কায় তৈরি হয়েছে, (যার কারণে আমরা হিমালয় পর্বতমালা পেয়েছি এবং যেখানে গত বছরের ভয়াবহ নেপালের ভূমিকম্প হয়েছে) সেটা খুবই সাবধানে বাংলাদেশকে এড়িয়ে তার উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে দক্ষিণে নেমে গেছে। এটুকু পড়েই কেউ যেন আনন্দে বগল বাজাতে না থাকে দুই কারণে। প্রথমত, ফল্ট লাইনটি বাংলাদেশের যথেষ্ট কাছ দিয়ে গেছে এবং সেখানে বড় ভূমিকম্প হলে আমরা বাংলাদেশে বসে সেটা খুব ভালোভাবেই টের পাব, নেপালের ভূমিকম্প এবং কয়েকদিন আগের মনিপুরের ভূমিকম্পে আমরা সেটা দেখেছি। দ্বিতীয় কারণে বড় ফল্ট লাইন ছাড়াও ছোট ছোট এমনকি অজানা ফল্ট লাইনও থাকতে পারে যেগুলো আমাদের মাঝে মধ্যে চমকে দিতে পারে।

আমাদের কতখানি চমকে দিতে পারে সেটা অনুমান করার জন্য বাংলাদেশ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমানার ভেতর কতগুলো ভূমিকম্প হয়েছে আমি সেটার তালিকা বের করে দেখেছি। সংখ্যাটি মোটেও বেশি নয়। এই সময়ে সারা পৃথিবীতে পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার, তার মধ্যে মাত্র দশটি হয়েছে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। ছয় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার, বাংলাদেশে হয়েছে মাত্র একটি! সেটিও হয়েছে সিলেট এলাকায়, একেবারে ভারতবর্ষের সীমানার কাছাকাছি, ১৯৯৭ সালের মে মাসের ৮ তারিখ। কাজেই পরিসংখ্যানের যদি গুরুত্ব থাকে তাহলে আমি গত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের পরিসংখ্যান দেখে বাংলাদেশের ভেতরে একটা ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে যাবে সেই দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম নষ্ট করতে রাজি নই!

আমার পরিচিত যারাই ভূমিকম্প হলেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাদের ভয় কমানোর জন্য একটা উপদেশ দিয়েছি। বলেছি, যখন ভূমিকম্প হয় তখন তারা যেন মনে করে সেটি মোটেই তাদের পায়ের নিচে ঘটছে না প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেটি ঘটছে শত শত কিলোমিটার দূরে এবং এখানে বসে তারা শুধু দূরের একটা ভূমিকম্পের রেশটুকু টের পাচ্ছে। তাহলেই তাদের ভয় কমে যাবে। আজকাল ইন্টারনেটের যুগে ভূমিকম্প হওয়ার এক-দুই মিনিটের ভেতর আমরা বের করে ফেলতে পারি সেটা আসলে কতদূরে ঘটেছে। সেটা কয় মাত্রার ভূমিকম্প।

দূরে ভূমিকম্প হলে আমরা তার রেশটুকু কীভাবে অনুভব করব সেটাও মোটামুটি অনুমান করা যায়। আমরা আসলে কম্পনটুকু অনুভব করি তাই যখন কম্পন বেশি হয় আমরা বলি বড় ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্পের কেন্দ্র যতো দূরে হবে ভূমিকম্পের কম্পনও ততো কমে যাবে। খুবই সহজভাবে অনুমান করার জন্য বলা যায় দ্বিগুণ দূরত্বে সরে গেলে কম্পন চারগুণ কমে যাবে- কাজেই কিছুদিন আগের ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পটি সিলেটের মানুষরা যতো তীব্রভাবে অনুভব করেছে, ঢাকার দূরত্ব দ্বিগুণের মতো হওয়ার কারণে তার মাত্রা এক-চতুর্থাংশ অনুভব করেছে! (তারপরও ঢাকার লোকজন দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে!)

২.
আমার মনে হয় ভূমিকম্প নিয়ে অযৌক্তিক আতঙ্ক কমানোর জন্য যথেষ্ট তথ্য দেওয়া হয়েছে। এবারে মূল বিষয়ে আসা যাক, ভূমিকম্প চলতে থাকলে কী করতে হবে। আমি যেহেতু ভূমিকম্পের বিশেষজ্ঞ নই তাই নিজ থেকে কোনো উপদেশ না দিয়ে যারা এসব নিয়ে মাথা ঘামান তাদের বক্তব্য তুলে দিই। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া এলাকা ভূমিকম্পের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার সরকারি উপদেশটা এ রকম-
যদি ঘরের ভেতরে আছ তাহলে ঘরের ভেতরেই থাকো। একটা শক্ত টেবিলের নিচে গিয়ে টেবিলটাকে ধরে থাকো। যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে ঘরের ভেতরের দেয়ালের পাশে দাঁড়াও। বাইরের দেয়াল, জানালার কাচ, ভারী ফার্নিচার এসব থেকে দূরে থাকো। নিচে নামার জন্য লিফট ব্যবহার করো না। যদি বাইরে আছ তাহলে বাইরেই থাকো। উঁচু বিল্ডিং কিংবা ওপরের ঝুলন্ত ইলেকট্রিক তার থেকে সরে যাও!

আমি যেটা লিখেছি সেটা ক্যালিফোর্নিয়ার পদ্ধতি, আমাদের বাংলাদেশের নয়। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করে দেখেছি বাংলাদেশেও মোটামুটি এই একই উপদেশ দেওয়া হয়। ভূমিকম্পের সময় পুরো বিল্ডিং ধসে পড়ার ঘটনা খুব বেশি নেই কিন্তু ভূমিকম্পের সময় আশপাশের জিনিসপত্র শরীরের ওপর পড়ে আঘাত পাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে। তাই ভূমিকম্পের সময় প্রথম চেষ্টা করা হয় এ ধরনের আঘাত থেকে বাঁচানোর।

৩.
ভূমিকম্প নিয়ে কথা বলতে হলে আমি সব সময় সবাইকে একটা বিষয় মনে করিয়ে দিই (২০১০ সালে হাইতিতে রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়েছিল), সেই ভূমিকম্পে হাইতিতে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০১৫ সালে চিলিতে আট মাত্রা থেকে বেশি একটা ভূমিকম্পে মানুষ মারা গিয়েছে মাত্র তেরো জন। এখানে মনে রাখতে হবে আট মাত্রার ভূমিকম্প সাত মাত্রার ভূমিকম্প থেকে তিরিশগুণ বেশি শক্তিশালি!

বিষয়টা বিস্ময়কর মনে হলেও আসল কারণটি সহজ। চিলি পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি (১৯৬০ সালে সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালি রিখটার স্কেলে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়েছিল)। চিলি ধীরে ধীরে তাদের সব বিল্ডিং ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তুলেছে। সে কারণে বড় ভূমিকম্পতেও সেখানে ক্ষয়ক্ষতি বলতে গেলে হয় না। দরিদ্র হাইতিতে ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং নেই তাই সেখানে এতো সহজে এ রকম অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল।

বাংলাদেশে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্ক আছে, সচেতনতা নেই। ভূমিকেম্পর ব্যাপারে আমরা মোটেই হাইতি হতে চাই না- আমরা চিলি হতে চাই।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ।

লেখক : শিক্ষাবিদ।
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com