স্বপ্নডানায় একটি বছর

স্বপ্নডানায় একটি বছর
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৬, ০৯:২২:০৪
স্বপ্নডানায় একটি বছর
এস এম জাকির হোসাইন
প্রিন্ট অ-অ+
২৮ বছরের এক স্বপ্নবাজ দেশপ্রেমিক যুবকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সংগঠন। মানুষটি কিশোর বয়স থেকেই স্বল্পদৃষ্টির দরুণ মোটা কাচের চশমা পরতেন ঠিকই, কিন্তু চিন্তায় ছিলেন অভাবনীয় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এক সময় তিনি আন্দোলন করেছেন, সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই জুটবে না দেশবাসীর ভাগ্যে। তাই কালবিলম্ব না করে শুরু হলো তাঁর নতুন পথের যাত্রা। সে যাত্রা স্বাধীনতার যাত্রা। সে যাত্রা সার্বভৌম বাংলাদেশের যাত্রা। আমার-আপনার অসাম্প্রদায়িক একখণ্ড ভূখণ্ডের জন্য আত্মত্যাগের মহান যাত্রা। 
 
একজন সৈনিকের যেমন অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়াটা নিরর্থক তেমনি কোনো দাবি আদায়ে সাংগঠনিক প্রেক্ষাপট ছাড়া ছোটাছুটি করাও অর্থহীন। আর সেই ন্যায্য দাবি আদায়ের দায়িত্ববোধ থেকেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারির কনকনে শীতে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সংগঠনটি। সংগঠনটির নাম ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। সেদিনের ২৮ বছরের যুবাপুরুষটিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 
 
স্বাধীনতা অর্জনে কেবল এই সংগঠনেরই ১৭ হাজার নেতাকর্মী জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদেরই রক্তের বিনিময়ে আজ আমাদের লাল সবুজের পতাকা। আজ যখন মুক্ত বাতাসে সেই পতাকা উড়তে দেখি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় হৃদয়পূর্ণ হয়ে আসে। তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস থেকেই মাথা উঁচু করে বলতে সাহস পাই, আমি সেই বীর বাঙালির উত্তরসূরি। আমরা দেশের প্রয়োজনে অকাতরে জীবন দিতে পারি। হয়তো এ জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস’। পৃথিবীর আর কোন ছাত্র সংগঠনের এমন সৌভাগ্যের তকমা নেই। এটি ছাত্রলীগের অহংকার । 
 
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র দফা, ৬৯’র গণঅভ্যূত্থান, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মধ্য নব্বইয়ের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকার কথা রাজনৈতিক সচেতন মানুষের অজানা নয়। আজ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে। তাই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
 
গত বছরের ২৫-২৬ জুলাই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ছাত্রসংগঠন গৌরব, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলনে সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এর মধ্য দিয়ে পূরণ হয় একটি স্বপ্ন। খুব ছোটবেলায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। স্কুলজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করার সুযোগ আসে বটে কিন্তু একদিন সত্যিই বঙ্গবন্ধুর নিজহাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে দায়িত্ব পালন করবো এটা ছিলো স্বপ্নের মত। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাত্রদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত রেখেছেন বলেই আমার মত একজন সাধারণ ছাত্রলীগ কর্মী ও শিক্ষার্থী এমন একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনের অংশ হতে পেরেছি। যা একজন মানুষ হিসেবে আমার কাছে আমরণ গৌরবের হয়ে থাকবে। 
স্বপ্নডানায় একটি বছর
কবি বলেছেন ‘কেউ কথা রাখেনি’, কিন্তু আমরা বলতে চাই, আমরা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কথা রেখেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা যে ব্রত নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই ব্রত নিয়ে আজও পথ চলছি দুনির্বার। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শুধুমাত্র ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগঠন নয়। ছাত্রলীগ এদেশের সকল মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম। এটা প্রমাণিত। আজকে এখানে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও তিন লাখ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে, জাতীয় চার নেতা এবং ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে নিহত শহীদদের। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি জন্ম থেকে অদ্যাবধি সম্পৃক্ত ও ত্যাগী সকল অগ্রজ ও অনুজদেরকে। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়া সকল বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
 
 
এরই মধ্যে দেখতে দেখতে কেটে গেছে দায়িত্ব পাওয়ার একটি বছর। ৬৮ বছরে পদার্পণকারী ছাত্রলীগের কাছে একটি বছর খুব বেশি সময় নয়। তারপরও বিগত একটি বছর থেকে শিক্ষা নিয়েছি অনেক। চেষ্টা করেছি সবাইকে নিয়ে কাজ করতে, সবার ঐকান্তিক সহযোগিতায় সামনের দিকে এগিয়ে ব্রত নিয়ে পথ চলেছি। সারাদেশ ব্যাপী ছাত্র রাজনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করতে। এসব কাজে কতটুকু সফল হয়েছি, সেটি বিবেচনার দায়িত্ব সচেতন  পাঠক ও ছাত্র সমাজের ।
 
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই উপলব্ধি করি কতিপয় চ্যালেঞ্জ আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিয়মিত জাতীয় কর্মসূচি ছাড়াও  জাতীয় ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সুখি-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনকল্পে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে শক্তিশালী করা আমাদের সামনে প্রধান কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়। আমরা সেই কর্তব্যকাজে নিজেদেরকে বিলিয়ে সদা প্রস্তুত থাকছি।  
 
দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই বাঙালির জাতীয় জীবনের কালো অধ্যায় শোকের মাস আগস্টের মধ্য দিয়ে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয় নতুন উদ্যমে। মাসব্যাপী শোক দিবসের আলোচনা সভা ও বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে নানা প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় শোকাবহ আগস্ট। এছাড়াও ২১শে আগস্ট গ্রেনেট হামলা দিবস, জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মদিন উদ্যাপন, জেলহত্যা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, জাতীয় শহীদ দিবস, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস, ২৫শে মার্চের কালোরাত, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ উদযাপন, দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, বঙ্গবন্ধু কন্যার কারামুক্তি দিবসসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করি। অন্যদিকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, সেচ্ছ্বায় রক্তদান কর্মসূচি, খেলাধুলার মতো জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিও পালিত হয়। 
 
সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিতরণ এবং ছিন্নমূল শিশুশিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়। সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ শিক্ষার্থে আগত নবী ছাত্র-ছাত্রী বন্ধুদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানায়।  
 
এছাড়াও সারাদেশে ছাত্রলীগের কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে গত মাসের শুরুতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের পক্ষ থেকে ‘বর্ধিত সভা ও কর্মশালা’র আয়োজন করা হয়। সারাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রনেতারা অংশগ্রহণ করে তাদের সমস্যাগুলো উপস্থাপনের পাশাপাশি সাবেক নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় নেতাদের অভিজ্ঞতালব্দ বক্তৃতা শুনে পর্যাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ করে। 
 
তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে বিভিন্ন পরামর্শ দান করি। এধরণের বর্ধিত সভা ও কর্মশালা সামনের দিনগুলোতেও আয়োজন করতে পারবো বলে প্রত্যাশা রাখি। এত সারাদেশ ব্যাপী ছাত্রলীগের একদল দক্ষকমী বাহিনী তৈরি করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। 
 
এদিকে সাম্প্রতি সময়ে গুলশান ও শোলাকিয়া ঈদগা ময়দানে জঙ্গি হামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত করার বিষয়টি সামনে এসেছে। এটা সহজে অনুমেয় যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক ও জীবনঘনিষ্ঠ রাজনীতির চালু না থাকায় শিক্ষার্থীরা ভুল পথে পা দিচ্ছেন। তাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক রাজনীতি সেখানে পৌঁছাতে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।  কাজ করে যাবে প্রত্যোকটি জেলা ইউনিটসহ উপজেলা ইউনিট এমন কি তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত করতে। 
 
 
আজ যখন দেখি ছাত্রলীগের কর্মীরা নিজেরা রান্না করে বন্যার্তদের মাঝে খাবার বিতরণ কিংবা জনদুর্ভোগ কমাতে কোমড়ে গামছা বেঁধে কোদাল হাতে মাটি কাঁটায় নেমেছে সত্যেই গর্ব হয়। যখন দেখি অসহায় পথশিশুদের পাশে একবেলার আনন্দ হয়েও দাঁড়িয়েছে কিংবা গরীব দুঃখীদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে সত্যিই তখন নিজেদের ধন্যমনে হয়। এইতো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার ছেলেরা। এই তো বাংলাদেশ গড়ার কারিগরেরা। এসব মুজিব সেনারা যদি জেগে থাকে কোন অপশক্তিই বাংলাদেশের উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করতে পারবে না। 
 
গত একটি বছর ধরে নতুন করে আমাদের পথ চলা শুরু হয়েছে। এই চলার পথে পেয়েছি অনেক মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা, যার মূল্য দেওয়ার সামর্থ্য সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেননি। এসব ভালোবাসাই আমাদের চলার পথের পাথেয়। নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন আমাদের শক্তি। 
 
দেশরত্ন শেখ হাসিনা ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে যাত্রা  শুরু করেছেন সামনের দিনগুলোতে সেই যাত্রার সারথি হয়ে হাত হাত রেখে কাঁধে কাঁধ রেখে সামনে এগিয়ে যাবো। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। 
 
পরিশেষে বলতে চাই, বাঙালির রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু মুজিবের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি গর্বিত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হতে পেরে আমি ইতিহাসের কাছে চিরঋণী। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করায় মানচিত্রের কাছে আমার মায়ের নাড়িছেঁড়া রক্তের ঋণ। আর বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশে কাজ করতে পারায় আমি সময়ের কাছে কৃতজ্ঞ।   
 
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু
 
লেখক: সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ  
 
বিবার্তা/জিয়া
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com