চোখ যে মনের কথা বলে

চোখ যে মনের কথা বলে
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০১৬, ০৮:৪৮:০২
চোখ যে মনের কথা বলে
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+
পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে চোখ অপার বিস্ময়। রহস্যের চাদরে মোড়া এর ভাষা আর প্রতি সেকেন্ডের গতি, প্রতিটি মুহূর্ত। মনের ভাব বুঝে নিতে চোখের জুড়ি নেই। মানবদেহে এটা এমন একটি স্পর্শকাতর অঙ্গ যা অন্য সব অঙ্গের পর সচল হয়। কারণ মায়ের উদরে চোখ ছাড়া সব মানব অঙ্গই সক্রিয় থাকে। শিশু জন্মের পরই প্রথম চোখ মেলে স্বপ্নের পৃথিবীটাকে ধীরে ধীরে দেখে। সম্ভবত এ কারণেই ভাস্কর্যবিদরা তাদের শিল্পকর্মের চূড়ান্ত পর্বে এসে চোখের আদল ফুটিয়ে তোলেন। এটাই মানব শিশু বা শিল্পকর্মের ‘আঁখি উন্মীলন’।
 
সন্দেহ নেই ভাবের সম্মোহন, আবেগের তূর্ণগতি আর মাদকতা সৃষ্টির এক সৃষ্টিশীল আধার এই মানবীয় অঙ্গটি। কবিকুল কি এ কারণেই কাতর আঁখি মেলে আত্মসত্তার সন্ধান করে যান জীবনভর? বোধের অপার্থিব পারাপারে সব চোখের ভাষা একই কায়দায় অনুবাদ করা যায় না। কারণ কারো কারো চোখ শুধু বহিরঙ্গের মতো ঝলসিতই নয়, এর অন্তঃপ্রবাহেও বিচ্ছুরিত। জীবনের সাতরং আর সৌন্দর্যের অবলোকন চুটিয়ে উপভোগের জন্য চাই বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি। চর্মচোখে একজন শিল্পী যা দেখেন, তা তিনি তার ভাবনার পাড়ে জামদানি শাড়ির মতো বুনন করে যান অবলীলায়, একের পর এক নিজের মতো করে। এ কারণে চোখ এক অনিঃশেষ তাৎপর্যময় অথচ সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ জটিল অঙ্গ।
 
চোখ রূপের নেকাব পরে অন্তহীন সৌন্দর্যের উৎসমূলেও নিরন্তর ছুটতে পারে। আবার চোখ যেমন হয়ে উঠতে পারে ধ্বংসের নিঃশব্দ ইমেইল, তেমনি হয়ে উঠতে পারে জীবন-শিকারি এক বিমূর্ত আকাক্সক্ষার স্বপ্নিল ইশারা। তাই চোখের ব্যাকরণ উপলব্ধি করতে না পেরে অনেকে বিভ্রান্ত জহুরিতে পরিণত হয়ে কপাল চাপড়ান অথবা পানির আরেক জ্ঞাতিভাই ‘চোখের জলে’ শূন্য বুকটা ভেজান।
 
চোখ তো শতাব্দীর খেলাঘর। আর এ খেলাঘরে প্রতিনিয়ত জেগে ওঠে নাম না জানা হাজারো শিহরণ, কত দুর্ঘটনা, শাশ্বত প্রেমের নন্দিত আবাহন। এটা কখনও আনন্দে হয়ে ওঠে উদ্বেল, কখনওবা বিষণœতার সন্ত্রাসে হয় জীবনাহত। এটা মানব মনে যেমন সূর্যের স্বাক্ষর এঁকে দিতে পারে, তেমনি পারে হতাশার আপাতমস্তক অন্ধকার পর্দা টেনে দিতে। চোখের সামান্য কুঞ্চনে যেমন প্রথম আবেগের বন্ধ দরজা খুলে যেতে পারে, উন্মোচিত হতে পারে জীবনের এক অচেনা পৃষ্ঠা, স্বপ্নের পৃথিবী উন্মোচিত হতে পারে চোখে চোখ পড়া মাত্র। তেমনি জানাতে পারে স্বপ্নভঙ্গের নির্মম বেদনাও।
 
চোখ প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আশাবাদিতার উৎস। তবে মুহূর্তের অবিশ্বাসে এটা হয়ে যেতে পারে স্বপ্নভাঙার মর্মভেদী নির্ঝর, অবরুদ্ধ ইচ্ছার দেয়ালে ছড়িয়ে দিতে পারে কাঁটা আর কাঁটা।চোখের মধ্যেই দেখা যায় ভেতরের মানুষটিকে, মানুষ খুঁজে নিতে পারে পৃথিবীর তাবৎ কবিতা- স্বপ্ন ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব, ইচ্ছা ও অনিচ্ছার দ্বৈরথ, শান্তি আর অশান্তির টানাপড়েন। প্রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে কত কবি যে তার বিশ্বাসে সোপর্দ শব্দের ইমারত গড়েছেন, তার হিসাব কে রাখে!
 
চোখের ভাষার পাঠোদ্ধারে সবাই সমান পারঙ্গম নন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বুদ্ধির আলো নয়, মোহের অন্ধকারেই জীবন চলার নকিব হয়ে যেতে পারে। তারপরও দুটো চোখের নিরাবরণ অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী শব্দহীন কথোপকথনের মধ্য দিয়েই অনেক সময় নিমিষে রচিত হয়ে যায় জীবনবিশ্বাসী চেতনার উপভোগ্য কবিতা। এ ক্ষেত্রে কবিরা নাকি তাদের চোখের ভাষার মুগ্ধতায় চারপাশের জীবনসত্য সহজে মুখস্থ করে নিতে পারেন ঈর্ষণীয় দক্ষতায়।
 
চোখ একটি উৎকৃষ্ট সজ্ঞান। এটা একটা নিশ্চিত হিরণ্ময় নক্ষত্র। মনের প্রেরণায় চোখের দৃষ্টি দিয়েই চিন্তাবিদরা সমকালীন আবর্জনাগুলো চিহ্নিত করে সমাজকে ঋদ্ধ করেন। আবার সে চোখই মানে না মনের শাসন। এটা দূরদূরান্তের অপরিচিতজনকেও আপন বানাতে শক্তি জোগায় এক দুর্নিবার তৃষ্ণায়। চোখের মনোজ্ঞ মৌলিকতা এখানেই। কখনও তা সুস্পষ্ট, কখনওবা রহস্যাবৃত। চোখের পরাজয় ঘটে শুধু এক জায়গায়, আর তা হচ্ছে সৌন্দর্য। কারণ সুন্দরকে শতবার দেখার পরও চোখ তৃপ্ত হয় না।
 
আসলে চোখ শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অঙ্গই নয়। কখনওবা চোখ একটি উচ্ছল প্রাণবন্ত প্রেমের কবিতা, যা জন কীটসের যে কোনো সরস কবিতাকেও ম্লান করে দিতে পারে। শল্যবিদের ডিসেকশন টেবিলে চোখের সব সারবত্তা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না। কারণ মানুষের লবণাক্ত চোখের ভেতর ঘনীভূত থাকতে পারে অদৃশ্য জিজ্ঞাসা। এ জিজ্ঞাসার জবাব চাইতে গিয়ে কবির কল্পনাও নিঃশেষ হয়ে যায়। চোখের ভাষার যে মাপকাঠি নেই!
 
এটা ঠিক, মানুষের দৈহিক সৌন্দর্যে চোখ নিজেই এক অনন্য অঙ্গ। সুন্দর চোখ দেখে আমাদেরও চোখ জুড়িয়ে যায়। চোখ যে ভালোবাসার প্রতীক। এটার সৌন্দর্য যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়- ‘চোখ সুন্দর’।
 
সন্দেহ নেই, শাস্ত্রকার ও সাহিত্যিকরা নারীর চোখ নিয়ে এত মজাদার উপমা সৃষ্টি করেছেন, যা কল্পনাকেও হার মানায়। এগুলোর মধ্যে শ্লীল-অশ্লীল দুই-ই আছে। কেউ বলেছেন, পটল চেরা আঁখি কখনও ‘আকাশ’, কখনওবা ‘নারকেল বিথি ঘেরা সুনীল দিঘি’। কেউবা বলেন, ‘ও চোখের চাহনিতে ধারালো সব তীর সাজানো রয়েছে থরে-বিথরে।’ কেউবা বলেন, ‘আঁখি বাণে হিয়া জর জর’।
 
সত্যিই নারীর চোখের বাঁকা চাহনি কটাক্ষ হানায় তুলনাহীন। বাঁকা চোখে ছুড়ে দেয় ‘কষ্ট-আনন্দ-প্রেম’। আবার সেই নারীই চোখের জলে মুক্তোর মালা গাঁথে, কেউবা চোখের জলে সারা জীবন ভাসেন। রবিঠাকুর বলেছেন, ‘অশ্রুজল কাঁদলে তা বেলফুল হয়ে যায়।’
 
নারী চোখের নিঃসীম গভীরতা কবি নাকি তার কল্পনার রশিতেও নাগাল পান না। সাত সাগরের গভীরতা নাকি ওই দুটো চোখে। আর পাপড়িগুলো যেন পদ্ম সরোবরের তীরে ঝাউ-মহুয়া কিংবা পুকুর পাড়ে তরু শ্রেণি। ভ্রু দুটো নাকি বাঁকা ছুরি- কামের কামান। আবার ইংলিশ নাট্যকার শেক্সপিয়ার নারীর চোখকে প্রমিথিউসের আগুনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ আগুন কাউকে শীতল প্রশান্তি এনে দেয়। কাউকে আবার জ্বালিয়ে অঙ্গার করে। তারপরও এটা সত্য, নারী তার দুরবিন চোখ মেলে পুরুষের মনের অনেক ছবিই তুলে নিতে পারে। পুরুষের বেলায় সচরাচর তা ঘটে না। বরং নারীর রহস্যময়ী চোখের সহজ-সরল অনুবাদ জানতে পুরুষ প্রাণপাত করে।
 
নারী চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেউ কেউ আরও এক ধাপ ওপরে উঠেছেন। তাদের মতে, যৌবনে নারীর চোখ নাকি নিজেই শিল্প হয়ে ওঠে। তাই এটা কখনও চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ, কখনও রূপালি রোদের মতো ঝকমকে, কখনওবা প্রশান্ত বিলের জলের মতো নিস্তরঙ্গ, আবার কখনওবা ঝরনার মতো ঝরঝর করে কথা বলে।
 
বিবার্তা/জিয়া
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2025 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com