সর্বকনিষ্ঠ এফসিপিএস’র গল্প

সর্বকনিষ্ঠ এফসিপিএস’র গল্প
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০১৬, ২১:৪৮:১৫
সর্বকনিষ্ঠ এফসিপিএস’র গল্প
মো. মহসিন হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+
দেশের সর্বকনিষ্ঠ এফসিপিএস’র মুহাম্মদ মিজানুর রহমান। ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবেন। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। তবে স্বপ্ন আরো আছে। এত কম বয়সে এফসিপিএস পাস করা কম কথা নয়। কিভাবে সম্ভব হলো? প্রশ্ন ছিল তার কাছে। 
 
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এসেছিলেন বিবার্তা অফিসে। জীবনের নানা দিক নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলেন বার্তা সম্পাদক মহসিন হোসেনের সঙ্গে। আজ আপনাদের শুনাবো ডাক্তার মুহাম্মদ মিজানুর রহমানের সেই গল্প। আসুন তার মুখেই শুনি।   
 
আপনার বেড়ে ওঠা, শৈশব-কৈশোর এবং বর্তমান নিয়ে কিছু বলুন।
 
বাবা-মা, ছয় ভাই আর দুই বোন নিয়ে আমাদের পরিবার। বাবা আকবর হোসেন ব্যবসা করেন। মা নূরজাহান বেগম গৃহিনী। আমার গ্রামের নাম মহিষাপুর। এটি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নে। আমার পড়ালেখা শুরু হয় রামদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৯২ সালের কোনো একদিন বড় ভাইদের হাত ধরেই ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। 
 
ওই স্কুল হতে ৫ম শ্রেণিতে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাস করি। এরপর মধুখালী পাইলট হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। ২০০২ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ৬০ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। আমি গোটা স্কুলের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে এসএসসি পাস করি। এরপর ঢাকায় চলে আসি। 
 
আমাদের পরিবারের ভাই বোন অধিকাংশই এসএসসি পাসের পর ঢাকায় পড়াশোনা করতো। তাদের হাত ধরেই আমিও ২০০৩ সালে তেজগাঁওয়ে সরকারি  বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হই। 
 
বিজ্ঞান কলেজ থেকে ২০০৪ সালে আমিসহ ১৭ জন এ প্লাস পেয়ে এইচএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘ক’ ইউনিটে মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অর্জন করি। কিন্তু ভর্তি হইনি। পরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে বিডিএস-এ ভর্তি হই। নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ২০০৯ সালে বিডিএস পাস করি। ২০১০ সালে ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারিতে এফসিপিএস পার্ট-১ একবারে পাস করি। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে চার বছর এফসিপিএস পার্ট-২ ট্রেনিং করি। ২০১৪ সালে আমার ট্রেনিং শেষ হয়। এরপর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে এফসিপিএস পার্ট-২ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথমবারেই পাস করি। তখন আমার বয়স ছিল ২৭ বছর ৯ মাস। 
 
এফসিপিএস পাস করার পর মেন্ডি ডেন্টাল কলেজের ওর‌্যাল এন্ড মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগে সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে জয়েন করি। বর্তমানে ওখানেই আছি। পাশাপাশি ফার্মগেটের ৭৬ গ্রীনরোডে প্যাসিফিক ডেন্টাল কেয়ার নামে আমার নিজস্ব চেম্বার আছে।  
 
সর্বকনিষ্ঠ এফসিপিএস’র গল্প
 
স্কুল জীবনের কোনো ঘটনা কী পাঠকদের জন্য বলবেন? যা আপনার মনে আছে। 
 
আসলে স্কুল জীবনেতো অনেক ঘটনাই আছে। কিন্তু সবতো আর মনে থাকে না। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করি। রেজাল্ট হওয়ার আগের দিন রাতে জানতে পেরে সারারাত ঘুম হয়নি। পরের দিন সকালে মায়ের সাথে রান্না ঘরে বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। এই অজ্ঞান হওয়াটা অবশ্য আনন্দেরই ছিল। আমাদের হাই স্কুলে একবার উপস্থিত বুদ্ধির প্রতিযোগিতা হয়েছিল। এতে ফাইনালে যায় ৯ম ও ১০ম শ্রেণি। আমরা ১০ম শ্রেণি ওই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করেছিলাম। এছাড়া প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় একবার মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতায় ২য় হয়েছিলাম, সেটা মনে পড়ছে। 
 
ওই স্কুল থেকেই আমরা ৮ ভাই বোন এসএসসি পাস করেছি। এটা একটা স্মরণীয় ঘটনা যে, আমরা ৮ ভাই বোনই এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে বড় ভাই আবুল বাশার রিপন প্রাইমেশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে লেখাপড়া করেন।  বুয়েট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা মেঝ ভাই অন্যরকম গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এই ভাই এইচএসসি পরীক্ষায় 
২০০০ সালে ঢাকা বোর্ডে ১২তম স্থান অধিকার করেন। অন্যরকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে রকমারি ডট কম, অন্যরকম সফটওয়্যার, অন্যরকম ইলেক্ট্রনিক্স, পাইল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড, টেকসপ বিডি ডট কম। যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্নরকম আবিষ্কারের জন্য নিরন্তর গবেষণারত। অন্যরকম গ্রুপের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (EVM)।
 
তৃতীয় ভাইও ইঞ্জিনিয়ার। তিনি খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। আমি এফসিপিএস পাস করে চিকিৎসা সেবায় আছি। পঞ্চম ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সবার ছোট ভাই সাইফুর রহমান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলট (ফ্লাইং অফিসার)। বড় বোন ফরিদপুর সুগার মিলস্ হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আর ছোট বোন ডাক্তার।      
 
পরিবারের সদস্যদের এই সফলতার জন্য ২০১২ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমার বাবা-মাকে সাকসেসফুল প্যারেন্টস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। 
 
স্কুল জীবনে আপনার প্রিয় স্যার কে ছিলেন? কার প্রেরণায় আপনি ভাল রেজাল্ট করতে পেরেছেন বলে মনে হয়?
 
আমার স্কুলের অনেক শিক্ষক-ই প্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে ফরিদ স্যার, আকবর স্যারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। ওনারা আমাকে পড়াশুনার ব্যাপারে অনেক সহায়তা করেছেন। এছাড়া আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল খালেক স্যারও পড়াশুনার ব্যাপারে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। 
 
ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক কোনো দলের সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা? 
 
আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। দাদার ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। বাবা-চাচারাও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তারা ছিলেন আমাদের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পৌঁছেছিল হানাদার বাহিনীর কাছে। আমার তখন জন্ম হয়নি। মা-বাবা, চাচাদের কাছে শুনেছি। ৭১ সালে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী আমাদের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।  
 
স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর আল সামস এর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতের রাজনীতি কখনোই পছন্দ করি না। ছোট বয়স থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। এখন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের আজীবন সদস্য হিসেবে আছি। আমার স্বাচিপ কোড নম্বর-এলএম (লাইফ মেম্বার)-৬৮০১৪৭৩।
 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে গড়ে ওঠা আমাদের পরিবারের কেউ কখনো স্বাধীনতা বিরোধীদের সমর্থন করেনি। আমাদের বাড়ি ফরিদপুর জেলা বরাবরই আওয়ামীলীগ অধ্যুসিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। আমাদের নির্বাচনী আসনে কখনো আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য কোনো দল জয়লাভ করতে পারেনি। কোনোদিন পারবে বলেও মনে হয় না।  
 
ব্যক্তিগত জীবনে আপনি কী বিবাহিত? জ্বি না, আমি এখনো বিবাহ করিনি। 
 
চিকিৎসা জগতের একজন সফল ছাত্র হিসেবে আপনার পরবর্তী লক্ষ্য কী? 
 
মানুষের সেবা করাই চিকিৎসকদের মূল লক্ষ্য। আমিও সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। 
 
আমি দেশের প্রথম এবং একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চাই। সেখানে আরো উন্নত গবেষণা করতে চাই। ওর্যা ল ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করে ওই রোগের চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের ইচ্ছা আছে। 
 
ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন হিসেবে দেশের মানুষের প্রতি আপনার কিছু বলার আছে কী? 
 
হ্যাঁ, দেশের সব মানুষের কাছে আমার প্রথম অনুরোধ আপনারা প্রতিদিন অন্তত দুবার খাওয়ার পরে ব্রাশ করবেন। এটা রাতে ও সকালে করাটাই উত্তম। এছাড়া মুখের ভেতরে যাদের ঘা হয় সেটা যদি দুই সপ্তাহের বেশি থাকে তাহলে অবশ্যই লোফেসিয়াল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ ওই ঘা থেকে অনেক সময় ক্যান্সার হয়ে যায়। 
 
দেশের সব মানুষের কাছে আমার আরো একটি অনুরোধ আপনারা পান ও জর্দ্দা খাবেন না। মুখের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হলো পান ও জর্দ্দা।  
 
যারা প্রায়ই দাঁতের ব্যাথায় ভোগেন তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী? তাদের জন্য পরামর্শ, দাঁতের ব্যাথার জন্য দীর্ঘদিন ব্যাথার ট্যাবলেট খাবেন না। এতে কিডনির ক্ষতি হয়। দাঁতে ব্যাথা হলে অবশ্যই বিডিএস পাস করা ভাল ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। 
 
দেশের আনাচে কানাচে অনেক দাঁতের ডাক্তারের চেম্বার দেখা যায়। এসব জায়গায় চিকিৎসা নেয়াটা কতটা নিরাপদ?
 
দাঁতের চিকিৎসা করতে হলে ন্যূনতম বিডিএস পাস করতে হয়। বিডিএস ছাড়া দাঁতের চিকিৎসা করা উচিত নয়। যারা কোনো রকম ট্রেনিং নিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করছেন তাদেরও যেমন এই কাজ করা উচিত নয়। তেমনি রোগীদেরও সচেতন হতে হবে। সাইন বোর্ড দেখেই যেন চিকিৎসা করাতে না যান। ভাল ডাক্তারের কাছে যাবেন। এটাই আমার পরামর্শ। 
 
অনেকের খাওয়ার সময় গালে কামড় লাগে। এ বিষয়ে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কী? 
 
হ্যাঁ দাঁত বাকা থাকলে অথবা পজিশন ঠিক না থাকলে এ ধরণের সমস্যা হয়। খেতে গেলে মাঝে মাঝে গালের ভেতরের অংশে কামড় লাগে। এটা একটা সমস্যা। এ ধরণের সমস্যারও চিকিৎসা আছে। বার বার এমন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তা না হলে পরবর্তীতে ওই স্থানে ঘাঁ হয়ে পরবর্তীতে বড় ধরণের সমস্যা হতে পারে। 
 
বিবার্তা/এমহোসেন
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com