বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভুল কবিতা!

বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভুল কবিতা!
প্রকাশ : ৩০ মে ২০১৬, ০৫:৪৮:০৭
বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভুল কবিতা!
বিবার্তা ডেস্ক :
প্রিন্ট অ-অ+
নিকষ কালো পাথরের মাঝে সাদা অক্ষরে লেখা পঙ্ক্তি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা 'যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা/গৌরী, যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান'। গত দুই দশক ধরে এভাবেই উদৃব্দত হয়ে আছে ম্যুরালের গায়ে। কিন্তু উদৃব্দতিটি যে ভুল, তা এত দিনেও কারও নজরে পড়েনি। 
 
অন্নদাশঙ্কর রায় রচিত কবিতাটিতে লেখা হয়েছিল ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান’। ম্যুরালের গায়ে উদৃব্দত কবিতায় ‘যমুনা’র জায়গায় ‘মেঘনা’ আর ‘মেঘনা’র জায়গায় ‘যমুনা’ লেখা রয়েছে। সে সঙ্গে ওই কবিতার প্রথম চার লাইনে কোনো কমার ব্যবহার না থাকলেও ম্যুরালে কমা ব্যবহার করা হয়েছে। 
 
অতি আশ্চর্যের বিষয়, বর্তমানে মূল কবিতাটির বদলে সর্বত্র এখন ভুল উদৃব্দতিটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে অন্নদাশঙ্কর রায়ের তিনটি বই বিশ্লেষণ করে খুব সহজেই ভুলটি ধরা পড়েছে। সে সঙ্গে কবিতাটি যে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু কবি অন্নদাশঙ্কর রায় রচিত, সেটিরও উল্লেখ নেই ম্যুরালের গায়ে। ভুলের বিষয়টি জানিয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে দ্রুত ভুল সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর ও সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান।
 
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা অন্যদিন থেকে প্রকাশিত ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’ কাব্যগ্রন্থে প্রথমবার ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে এ কবিতা প্রকাশিত হয়। অন্যদিনের স্বত্বাধিকারী শিশির ভট্টাচার্য সম্পাদিত ওই কাব্যগ্রন্থের ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' কবিতার নিচে অন্নদাশঙ্করের 'বঙ্গবন্ধু' কবিতাটি ছাপা হয়। এতে লেখা হয়, 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্ত গঙ্গা বহমান/ হতবু নাই ভয়, হবে হবে জয়/ জয় মুজিবর রহমান'। কবিতাটিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের বানান ‘শেখ মুজিবর রহমান’ লেখা হয়েছিল। কলকাতায় সে সময় মুজিবুরের বদলে মুজিবর লেখা হতো বলে সেখানকার একাত্তরের বিভিন্ন সংবাদপত্র ঘেঁটে নিশ্চিত হওয়া গেছে। 
 
তবে ১৯৯৮ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় কলকাতার স্বনামধন্য দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত 'কাঁদো, প্রিয় দেশ' নামে তার প্রবন্ধের বইয়ের একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে নিজের লেখা ওই কবিতার উদৃব্দতি দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের বানান সংশোধন করে দেন। ওই প্রবন্ধে কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন তিনি। ওই বইয়ের ১২২ নম্বর পৃষ্ঠায় অন্নদাশঙ্কর তার ওই কবিতা বিকৃত করার অভিযোগ তোলেন বাংলাদেশের এক বক্তার বিরুদ্ধে। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘একজন বক্তা চমৎকার বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে উল্লেখ করে আমার কবিতার পঙ্ক্তি একটু উলটিয়ে- 'যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরী যমুনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান'।’
 
অবশ্য ১৯৯৯ সালে কলকাতার আরেক স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. থেকে প্রকাশিত 'মুক্তবঙ্গের স্মৃতি' নামে অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় আবারও 'শেখ মুজিবর রহমান' ছাপা হয়েছে। একই বইয়ের ৩৪ নম্বর পৃষ্ঠায় তার কবিতাটি বিকৃতভাবে উদৃব্দত করার কথা উল্লেখ করেন অন্নদাশঙ্কর রায়। আগের বইয়ে তিনি বক্তা লিখলেও ওই একই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিতে গিয়ে এবার তিনি সরাসরি একজন মন্ত্রী তার কবিতার ভুল উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেই সভাতে এক মন্ত্রী আমার কবিতা আবৃত্তি করে শোনান-‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবর রহমান'। তিনি 'যমুনা'র জায়গায় 'মেঘনা' আর 'মেঘনা'র জায়গায় 'যমুনা' বসান। বাংলাদেশের একটি ডাকটিকিটে ওই দুটি লাইন এইভাবেই উদ্ধৃত হয়েছে।’
 
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের ম্যুরালের গায়ে কবিতা ভুলভাবে উদৃব্দত হওয়ার বিষয়ে সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চের (সিবিজিআর) চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জালাল বলেন, বঙ্গবন্ধু কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন। অন্নদাশঙ্কর রায়ও পণ্ডিত মানুষ। একজন পণ্ডিত মানুষ যখন একজন অসাধারণ মানুষকে নিয়ে কবিতা লেখেন, সেটা বুঝেশুনে তার পর লেখেন। কিন্তু কেউ এসে চট করে কবিতা পাল্টে দেবেন, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি আশা করব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভুল সংশোধন করা হবে। না হলে নতুন প্রজন্ম আরেকটি ভুল তথ্য জেনে বড় হবে।
 
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, প্রতিনিয়তই নানা অনুষ্ঠানের জন্য বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে যাওয়া হয়। কিন্তু অন্নদাশঙ্করের কবিতা উদৃব্দত করতে গিয়ে যে ভুল করা হয়েছে, সেটি চোখ এড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি একজন আমাকে ভুলের বিষয়টি জানিয়েছিলেন, কিন্তু আমি আর পরিদর্শনে যেতে পারিনি। তবে কোনোভাবেই উদৃব্দতি ভুলভাবে উপস্থাপন করা ঠিক হয়নি। বিশ্বব্যাপী উদৃব্দতি ব্যবহারের নিয়ম হচ্ছে যেভাবে লেখা রয়েছে, সেভাবেই ব্যবহার করতে হবে। সুতরাং আমি আশা করব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভুলটি জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সংশোধন করে নেবে।
 
 
বিবার্তা/এম হায়দার
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2025 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com