চীনের মহাপ্রাচীর (The Great Wall of China) পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি দীর্ঘ প্রাচীর সারি। এগুলি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে খ্রিস্টীয় ১৬শ শতক পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এরকম অনেকগুলি প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, তবে ২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াঙের অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি বর্তমান প্রাচীরের অনেক উত্তরে অবস্থিত এবং এর খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। বর্তমান প্রাচীরটি মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়।
চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। এই প্রাচীর প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উচু এবং ৬ হাজার ৫৩২ কিলোমিটার লম্বা। এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে।চীনের এই মহাপ্রাচীরের ধারণা বহুকালের পুরানা। যখন থেকে সভ্যতার আবর্তন শুরু হয়েছে তলোয়ার ও রক্তের পরিমাপের ওপর তখন থেকেই সারা প্রথিবীতে সবাই অনিরাপদ হয়ে গেছে। নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এই প্রাচীর নির্মাণের ধারণা হাজার বছরের পুরোনো। যেমন, নিজের সাম্রাজ্য ও প্রজাদের বহি:বিশ্ব তথা যাযাবর জাতি থেকে বাঁচানোর জন্য খ্রিষ্টপূর্ব ২২০-২০০৬ এ চীনের প্রাচীরের গোড়াপত্তন হয়। কয়েকটি প্রজন্মে ভাগ হয়ে সবশেষে আজকের মহাপ্রাচীর এর মূলভিত্তি রচিত হয় ১৫৬৯-১৫৭৫ এর সময়ে। যখন চীন পৃথিবীর সবথেকে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়।
প্রথম খ্রীষ্টপূর্ব ২২০-২০৬ এর সময়ে ছিন সাম্রাজ্যর সম্রাট ছিন শ্রি হুয়াং অল্প কিছু জায়গা জুড়ে চীনের উত্তর দিকে নির্মাণ করেন মহাপ্রাচীর। যা সাধারণত পাথর ও কাদায় তৈরী ছিল। এরপর বাকি ছয়টি চীনা উপসাম্রাজ্য তাদের নিজেদের সীমানা সম্প্রসারণ করে। এরপর অনেক বছর কেটে গেলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি সাধিত হয় না এ প্রাচীরের।চীনের ভৌগলিক সীমানার উত্তর দিকে ও তৎকালীন মঙ্গোলিয়ান এর দক্ষিন দিকের সীমান্তে যাযাবর মঙ্গোলিয়ানরা প্রায় ২ হাজার বছর ধরে চীনাদের বসতবাড়িতে হানা দিত, আগুন ধরিয়ে দিত, লুট করত ফসল, খাবার, আর অর্থকড়ি। মূলত মঙ্গোলিয়ানদের বিরান ভুখন্ডতে খাদ্যের অভাব এই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করে।সেপ্টেম্বর ১৫৫০, তৎকালীন মিং সাম্রাজ্যের রাজধানী বেইজিং। মঙ্গোলিয়ান যাযাবর জাতির নেতা চেঙ্গিস খান এর উত্তরসূরী দারাই সুং গুদেনখান। শান্ত চীনা ভূখন্ডে একদিন হুট করে আক্রমন করে বসে অস্ত্রসজ্জিত ক্ষুধার্ত মঙ্গলিয়ানরা।
রাজধানীর ৭০ মাইল দূরের জনপদে চলে গণহত্যা, লুণ্ঠন, আর যুদ্ধবন্দী করার নির্মমতা। এটি ছিল মঙ্গোলিয়ানদের সবথেকে ভয়াবহ আক্রমণ। তখন চীনের সম্রাটকে তারা একজন অন্ধ বন্দীর মাধ্যমে তাদের দাবি পেশ করে যে, মঙ্গোলিয়ানদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে ও ব্যবসাবাণিজ্য করতে হবে। তাহলে তারাও উন্নয়ন করতে পারবে নিজেদের ভূখন্ড। সম্রাট তার সভাসদদের বুদ্ধিতে তাদের কাছে কিছুটা সময় চান। কিন্তু তলে তলে চলে নতুন কোন বুদ্ধির খোঁজ।
প্রায় এক মাস ধংস্বযজ্ঞ চালিয়ে অক্টোবর ১৫, ১৫৫০ মঙ্গোলীয়ানরা ফিরে যায় নিজেদের জায়গায়। বেইজিং এর যুদ্ধমন্ত্রীকে তার ব্যর্থতা ও যুদ্ধ না করে পালানোর অপরাধে শিরশ্ছেদ করা হয় রাজপ্রাসাদে সবার সামনে।সেই সময় নতুন মুখ হিসাবে দেখা যায় চৌকস সেনা অফিসারকে। ২৩ বছর বয়সী ছি চি গুয়াং। সে এই ধংস্বযজ্ঞ দেখে মঙ্গোলীয়ানদের রুখে দাড়ানোর পরিকল্পনা শুরু করে। ২ হাজার বছর ধরে বারে বারে এই মঙ্গোলিয়ান জাতি আক্রমণ করে আসছিলো চায়নার মূল ভূখন্ডের উত্তর দিকের কয়েক হাজার মাইল এলাকায়, সেই এলাকাতে সে স্থায়ী সমাধানের ধারণা আনে যা সম্রাটের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।তাকে পাঠানো হয় জাপানীজদের আক্রমণ প্রতিহত করতে। নিজের চেষ্টায় তিনি গ্রামের কৃষকদের স্বদেশ বাঁচানোর লড়াই তে সৈনিক হিসাবে দাড় করান। তার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী আত্মপ্রকাশ করে।
জাপানীজদের সাথে কয়েকটা যুদ্ধে জয়লাভ করে।এর ১৭ বছর পর, জাপানীজদের সাথে বীরত্বের জন্য ছি চি গুয়াং কে সেনাপ্রধান করা হয়। তার পদ জেনারেল। ঠিক সেই সময় আবার মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণের আশংকা তৈরী হয়। তখনকার সম্রাটকে দ্বিতীয়বার মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মহাপ্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। তার শত্রুদের প্রচুর বিরোধীতা সত্ত্বেও সম্রাট তাকে মহাপ্রাচীর তৈরীর অনুমতি দেন।সেনানায়ক তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন সত্যিকারের মহাপ্রাচীর নির্মানের। ১৫৬৯ এর দিকে কাজ শুরু করা হয় প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিয়ে এবং প্রাথমিকভাবে মূল অংশের প্রাচীর নির্মানের জন্য ৫ বছর সময় বেধে দেয়া হয় সেনাপ্রধান কে। ইট পাথর আর পোড়ামাটি দিয়ে শুরু হয় কাজ।
একেকটি ইটের ওজন প্রায় ২০ কেজি। মানুষ দিয়ে পাহাড়ের গায়ে উঠিয়ে নিয়ে একটার পর একটা গেথে তৈরী করা হত প্রতিটি দুর্গ এবং দেয়াল। কয়েকশ গজ পর পর একটি করে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এর পরিকল্পনা এবং সব সুদ্ধ কয়েক হাজার টাওয়ার এর নির্মাণ মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজটাকে গুণগত দিক থেকে নিশ্ছিদ্র করা হয়। ৩০ ফুট উচু। এবং ১০ ফুট প্রশস্ত দেয়াল।কিন্তু প্রতিটি দেয়ালের নকশা নিশ্চিত করা হয় যেন তা পাহাড়ের চূড়ার উপর দিয়ে তৈরী হয়। এটা একটা বিশাল সামরিক পরিকল্পনা। ২৫০ জন করে ভাগ করা প্রতিটি দল মিলে প্রথম বছরে তৈরী করে ৭০ টি টাওয়ার যা কিনা পর্যাপ্ত ছিল না। প্রতি ৫ দিনে একটি করে টাওয়ার তৈরীর নির্দশ ছিল প্রতি ২৫০ জনের দলের প্রতি। তারা রাতদিন কাজ করত। রাজ্যের মোট আয়ের ৭৫ ভাগ নি:শেষ হচ্ছিল এই মহাপ্রাচীর প্রকল্পতে।
কিন্তু বাধ সাধল কঠোর পরিশ্রমের কারণে ছড়িয়ে পড়া অপুষ্টি, চর্মরোগ, মানসিক অবসাদ সহ আরও কিছু রোগ। সৈনিকরা বছর ধরে পরিবার এর সাথে দেখা না করে যে কঠিন প্রকল্প শেষ করতে কাজ করছিল সেখানে বিনোদন বলতে ছিল না কিছুই। মরে যাওয়া সৈনিককে সহোদরের মতই ভেবে নিয়ে শেষকৃত্য শেষ করত বাকি সেন্যরা। পাতায় বোনা চাটাইয়ে তাদের মৃতদেহ সমাধিস্থ হত আজকের মহাপ্রাচীরের আশেপাশেই। গুয়াংচিয়াও , মহাপ্রাচীর নির্মাণের মহান সৈনিক তার আর সব সহযোদ্ধাদের মতই আজ ভুলে যাওয়া নায়ক। অথচ সে ই যোদ্ধাদের মধ্যে একনিষ্ঠতা, সহদরবৃত্তিকতা এবং শৃংখলা বজায় রেখে মহাপ্রাচীর সফল করতে সচেষ্ট ছিল।
জেনারেল ছি চিগুয়াং যখন দেখলেন তার সৈন্যরা বিদ্রোহ করে উঠতে পারে তখন তিনি ঘোষণা দিলেন তাদের পরিবার চাইলে তাদের সাথে যোগ দিতে পারে যা ছিল একই সাথে কাজ এগিয়ে নেয়া ও সেনাদের মনোবল চাঙ্গা রাখার উপায় । অনেক কঠিন পরিশ্রমের পর ১৫৭৫ সালের প্রথম দিকে প্রাচীরের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হয়।১৫৭৫ সালের মার্চ মাসের কোন একদিন এই প্রাচীর এর কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ হল । যাযাবর মঙ্গলিয়ানরা আবার আক্রমণ করে বসল প্রাচীর দ্বারা ঘেরা উত্তর প্রান্তে। কিন্তু এবার তারা সফল হল না। প্রাচীরের পিছনের সামরিক পরিকল্পনা কাজে দিল এবং যাযাবররা পালিয়ে গেল।
বর্তমান অবস্থা
বেইজিংয়ের উত্তরে এবং পর্যটন কেন্দ্রের কিছু অংশ সংরক্ষণ এমনকি পূণঃনির্মাণ করা হলেও দেয়ালের বেশ কিছু অংশ ধ্বংশের সম্মুখীন। ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো গ্রাম্য খেলার মাঠ এবং বাড়ি ও রাস্তা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পাথরের উংস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দেয়ালের কিছু অংশ নাশকতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেয়াল পূণঃনির্মাণের জন্য কিছু অংশ ধ্বংস করা হয়েছে। কোন পূর্ণাঙ্গ জরিপ না করার জন্য এটা জানা সম্ভব নয় যে কতটুকু স্থান রক্ষা পেয়েছে। উন্নত পর্যটন এলাকার নিকটে মেরামতকৃত অংশ পর্যটন পণ্যের বিক্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, সিআরআই।
বিবার্তা/মহসিন