হাওয়া ভবনের ৭ প্রভাবশালী কে কোথায়?

হাওয়া ভবনের ৭ প্রভাবশালী কে কোথায়?
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০১৬, ১২:৪৫:১৫
হাওয়া ভবনের ৭ প্রভাবশালী কে কোথায়?
বিশেষ প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তারেক রহমান হাওয়া ভবন থেকে নির্বাচনী জরিপ ও দলীয় মনোনয়ন প্রদানসহ নানামুখী সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনা করায় সারাদেশে তা পরিচিতি লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভের পর ওই চক্রটি তারেক রহমানকে সামনে রেখে হাওয়া ভবনকে প্যারালাল সরকার পরিচালনার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিকল্প একটি কার্যালয়ে পরিণত করে। তারেক রহমান বিগত সরকার ও বিএনপির ভেতর একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। হাওয়া ভবনকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের কিছু তরুণ মন্ত্রী-এমপির সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় পৃথক একটি মন্ত্রিসভা। 
 
এই ‘মন্ত্রিসভা’র সদস্যরা তারেক রহমানকে আগামীদিনের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রচার করতে থাকে। এভাবেই তারেক রহমানকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা হয়। তারেক রহমানও এদের পুরস্কৃত করেন একেকজনকে এক এক ‘সেক্টরের’ দায়িত্ব দিয়ে। এর মধ্যে তার মূল ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে, অর্থাৎ তিনি ‘অর্থমন্ত্রী’। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও প্রশাসনে দলীয় লোক নিয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুলকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পায় আশিক ইসলাম। হাওয়া ভবনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ দেয়া হয় জয়কে এবং বগুড়ার সন্তান নাইটকে প্রথমে তার ব্যক্তিগত সহকারী ও পরে আরেক ছাত্রদল নেতা মিয়া নুরুদ্দিন অপুকে দেয়া হয় এই পদ। 
 
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্বিক খোঁজখবর তারেককে পৌঁছে দেয়ার জন্য সাবেক ছাত্রদল নেতা ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবালকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব কর্মকর্তা তত্কালীন পাঁচ বছর তারেক রহমানের পাশাপাশি হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। একেবারে শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যায় অনেকে। এদের মেধা, দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানারকম অভিযোগ পেলেও মোটেও সেগুলো আমলে নিতেন না তারেক রহমান। উল্টো তার প্রশ্রয়ে এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। নিজেরা পরিণত হয়েছে টাকার কুমিরে। নিন্মে সেই কুখ্যাত হাওয়া ভবনের কিছু হাওয়া হয়ে যাওয়া ব্যক্তির তথ্য তুলে ধরা হলো। 
 
স্বয়ং তারেক রহমান দুর্নীতির মামলায় কারাগারে ও পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে চলে গেলেও তার বরপুত্ররা কেউ আত্মগোপনে, কেউ নিরুদ্দেশ, কেউ পালিয়ে আত্মরক্ষা করছেন। এখন খবর পাওয়া যাচ্ছে, প্রভাবশালী সেই আলোচিত-বিতর্কিত কর্মকর্তাদের কয়েকজন নিজ দেশে পরবাসী হয়েও নিয়মিত উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখেন। অর্থমন্ত্রী খ্যাত গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কারাগারেই আছেন।  
 
হাওয়া ভবনের আত্মঘোষিত মুখপাত্র আশিক ইসলাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে সবার আগে বিদেশে চলে যান এ ‘কর্মকর্তা’। চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেসসচিব এবং চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। সে সময় বিটিভি, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। হাওয়া ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন অকল্পনীয় গতিতে। কথিত রয়েছে, একসময় রাজধানীর ফকিরাপুলের একটি মেসে বসবাসকারী আশিক ইসলাম চারদলীয় জোট সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্রে একটি পেট্রোলপাম্প ও একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। নিজের বাড়িতেই এখন বসবাস করছেন তিনি। মাঝেমাঝে লন্ডনও সফর করেন এ আলোচিত কর্মকর্তা।
 
হাওয়া ভবনের আরেক ‘কর্মকর্তার’ নাম মিয়া নুরুদ্দিন অপু। হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল অপুর। তার ‘অনুমতি’ ছাড়া চারদলীয় জোট সরকারের কোনো মন্ত্রী-এমপিও হাওয়া ভবনে গিয়ে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ পেতেন না। ওয়ান ইলেভেনের পর তারেক রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত অপু বাংলাদেশেই ছিলেন। গ্রেফতারের পর তারেক রহমানকে যে রাতে ঢাকার নিন্ম আদালতে হাজির করা হয়, সে রাতে তিনিও আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থি ছিলেন। তারপর চলে যান মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে।দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পর দেশে ফিলে আদালতে আত্মসমর্পন করলে আদালত জামিন না মঞ্জুর করে তাকে জেলে পাঠায়। বর্তমানে তিনি জেলে। 
 
ছাত্রদলের সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল হাওয়া ভবনের ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তার’ দায়িত্ব পালন করতেন। হাওয়া ভবনের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশাসনে তার দাপটই ছিল সবচেয়ে বেশি। নানা বাণিজ্য করে চারদলের ৫ বছর কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি দেশেই রয়েছেন, তবে আত্মগোপনে। এর আগে ওয়ান ইলেভেনের সময় পালিয়ে গিয়ে কয়েকমাস দেশের বাইরেও ছিলেন। সে সময় মালয়েশিয়ায় ব্যবসা করতেন তিনি। বর্তমানে বিএনপির কোনো কোনো নেতার সঙ্গে তার প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
 
বগুড়ার সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর ছেলে জয় ছিলেন হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা। চারদলীয় জোট সরকারের পুরো সময় নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কাজগুলো অনৈতিকভাবে  নিজের লোকজনদের পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। লালুপুত্র জয় ওয়ান ইলেভেনের পর বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে দেশেই রয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রকাশ্যে তার দেখা পাওয়া যায় না।থাকেন বগুড়ায়। 
 
তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল একাধারে হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা হিসেবে নানা দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর অ্যাসাইনমেন্ট অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওয়ান ইলেভেনের পর বিদেশে পালিয়ে যান এ কর্মকর্তা। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন ফিরোজ। সেখানে তিনি ব্যবসা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
 
হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব তারেক রহমানের এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। হাওয়া ভবনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘অত্যন্ত ধুরন্ধর’ হিসেবে পরিচিত এ কর্মকর্তা ক্ষমতার দাপটে বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেও কৌশলের কারণে কিছু মহলের আলোচনার বাইরে ছিলেন। বিভিন্ন সূত্রের দাবি অনুযায়ী, কামরুল বর্তমানে দেশেই রয়েছেন। 
 
চারদলীয় জোট সরকারের দাপটশালী মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজের ছেলে অমিতাভ সিরাজও ছিলেন হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ভবনটির প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নানা অনৈতিক বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছেন। কিন্তু পরিচিত কোনো মহলেই তার যাতায়াত নেই।
 
আলোচিত সেই হাওয়া ভবন এখন আর নেই। পুরনো বাড়িটি ভেঙ্গে সেখানে তৈরি হয়েছে ভবন। তবু হাওয়া ভবনের নামটি গেঁথে আছে অনেকেরই মনে। কারণে, অকারণেও। তাই হাওয়া ভবনের সঙ্গে যুক্ত আলোচিত এই কর্মকর্তাদের নিয়ে কৌতুহল সব সময়ই থাকবে।হয়তো আরো কয়েকযুগ এই নামটি স্মরণ করবে এদেশের মানুষ। 
 
বিবার্তা/এমহোসেন.
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2025 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com