বাইরে তালা ভেতরে রমরমা কোচিং বাণিজ্য

বাইরে তালা ভেতরে রমরমা কোচিং বাণিজ্য
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:৪০:০৬
বাইরে তালা ভেতরে রমরমা কোচিং বাণিজ্য
ইকবাল হোসেন সুমন, নোয়াখালী
প্রিন্ট অ-অ+
নোয়াখালী জেলার ৯টি উপজেলা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার। সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে প্রশাসনের নাগের ডগায় চলছে এ কার্যক্রম। কোচিং সেন্টার বন্ধের সরকারি বিধি নিষেধ থাকলেও জেলা প্রশাসন এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ। যার ফলে বিপাকে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে নোয়াখালী জেলার অভিভাবক মহল। 
 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে সমকাল কোচিং, এফ কোচিং, মেধা বিকাশ কোচিং, জ্ঞানের আলো কোচিংসহ অসংখ্যা কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে নোয়াখালী জেলায়। এমনকি মাইজদীতে জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলোর পাশেই প্রকাশ্য দিবালোকে বিভিন্ন নামে বেনামে চলছে কোচিং বাণিজ্য। অনেকে বাইরে তালা লাগিয়ে ভেতরে দেদারসে কোচিং চালাচ্ছেন যাতে কেউ বুঝতে না পারে।
 
সূত্র জানায়, এসব কোচিং সেন্টারের বেশির ভাগের কর্ণধার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও  জেলা স্কুলের শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল এবং বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতার কথা বলে মোটা অংকের টাকা নিয়ে জেলার বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসায় অবাধে চলছে কোচিং বাণিজ্য। 
 
অভিভাবকরা বলেন, ভালো ফলাফলের কথা বলে তাদের উৎসাহিত করা হয় কোচিং-এ আসতে। কোনো শিক্ষার্থী না আসলে তাদের প্রতি ক্লাসে মনোযোগ দেন না শিক্ষকরা। অথচ অভিভাবকদের দাবির মুখে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের রাশ টেনে ধরতে ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বন্ধের নীতিমালা জারি করে সরকার। কিন্তু এ নীতিমালা কাগজেই রয়ে গেছে।
 
২০১৩ সালে গোয়েন্দা সংস্থা দেশের কোচিং-এ জড়িত ৫০০ শিক্ষকের তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকা ধরে কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। বেশ কিছু বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষককে শোকজ করা হয়েছিল। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নীতিমালা বাস্তবায়নের কাজ। এরপর আর নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। অথচ নীতিমালা না মেনে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। 
 
কোনো শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বেসরকারি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনুরূপ শাস্তির কথা বলা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নীতিমালা না মানলেও শাস্তি পেতে হয় না। 
 
অভিভাবকরা অভিযোগ করে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় কোচিং বাণিজ্য চলছে। 
 
অভিভাবকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লোক দেখানো এই নীতিমালা রেখে লাভ কার? এখন ৫ম ও ৮ম  শ্রেণিতে নিয়মিত কোনো ক্লাস নেই, যা হচ্ছে তার পুরোটাই কোচিং। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ভালো ফলের অজুহাতে বাধ্যতামূলক কোচিং করানো হচ্ছে। কোচিং ফি নির্ধারণ হচ্ছে ইচ্ছেমতো। এই কোচিং থেকে যা আসে তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও জড়িত শিক্ষকরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আর নিয়মিত টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।
 
নীতিমালায় বলা হয়েছে, অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধু অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। 
 
এক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে শহরে মাসিক সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা, জেলা শহরে ২০০ টাকা ও উপজেলা বা স্থানীয় পর্যায়ে ১৫০ টাকা করে রসিদের মাধ্যমে ফি গ্রহণ করা যাবে, যা সর্বোচ্চ ১২০০ টাকার বেশি হবে না। একটি বিষয়ে মাসে সর্বনিম্ম ১২টি ক্লাস অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি ক্লাসে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারবে।
 
সংগৃহীত ফি প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়ন্ত্রণে একটি আলাদা তহবিলে জমা থাকবে। প্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সহায়ক কর্মচারীদের ব্যয় বাবদ ১০ শতাংশ অর্থ রেখে বাকি টাকা নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। কিন্তু নীতিমালার এ অংশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কোচিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুই থেকে ৩ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সবাইকে কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। 
 
আবার অনেক শিক্ষক স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যে ব্যক্তিগত কোচিং ব্যবসা খুলেছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা তুলে পুরো টাকা নিজেই আত্মসাৎ করছেন। আবার একটি অংশ প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দিয়ে খুশি রাখছেন।
 
নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে দিনে অন্য প্রতিষ্ঠানের সীমিত সংখ্যক (১০ জনের বেশি নয়) শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন। 
 
অভিভাবকরা বলেন, তারা ক্লাসে ভালোমতো না পড়িয়ে অথবা পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেয়ার প্রলোভনে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়তে আসতে উৎসাহিত করছেন। ক্লাসের পড়া ক্লাসে শেষ করা হলে কোচিংয়ের প্রয়োজন হতো না।
 
জেলা প্রশাসক বদরে মুনর ফেরদৌস বলেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা কার্যকর করা প্রয়োজন। 
  
জেলা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের নোয়াখালী কর্মকতা আজিজুল হক জানান, বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। আমরা আবার উদ্যোগ নেব, যারা নীতিমালা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, শিক্ষা আইন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই আইন চূড়ান্ত হলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা আরও সহজ হবে।
 
বিবার্তা//ইকবাল//মাজহার
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com