সাত বছর পর বিএনপির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি হলো অথচ নেই কোনো উচ্ছ্বাস। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই দলের গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয় নেতাকর্মীশূন্য। সারা দেশের নেতাকর্মীদের মাঝে শুধুই হতাশার সুর। নেই কোনো আনন্দ মিছিল। তবে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সিনিয়র সহসভাপতি মামুনুর রশিদকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত করায় নোয়াখালীর চাটখিলে আনন্দ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সৎ, ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাদের নতুন কমিটিতে প্রাধান্য দেয়া হবে বলে বিএনপি চেয়ারপারসন যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা এই বিশাল কমিটিতে খুব সামান্যই প্রতিফলিত হয়েছে মনে করছেন দলটির তৃণমূল নেতারা। পদ দেয়া হয়নি সারাদেশের বহু সিনিয়র-জুনিয়র নেতাকে। বরং পদাবনতি করা হয়েছে অনেক ত্যাগী নেতাকে।
এদিকে নতুন কমিটি নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। রাজনীতির মাঠে বেকায়দায় থাকায় দলটিতে তাৎক্ষণিকভাবে এই ক্ষোভের বড় কোনো বহিঃপ্রকাশ না ঘটলেও কমিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই নেতা প্রকাশ্যেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন।
পদ পাওয়ার পরও অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন - এমন একজন হচ্ছেন বিএনপির সাবেক সহপ্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন। তিনি কমিটি ঘোষণার পরপর শনিবার বিকালে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গুডবাই বিএনপি, গুডবাই। বিদায়। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সম্পর্কের ইতি টানছি আজ...।’
জানা যায়, কমিটিতে এক নেতার এক পদে থাকার কথা থাকলেও অনেকাংশে তাও কার্যকর হয়নি। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনে থাকার পরও নতুন কমিটিতে সম্পাদকীয় পদে জায়গা করে নিয়েছেন অনেকেই।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে দলটির অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ-হতাশার এ চিত্র পাওয়া গেছে। তাদের অনেকের অভিযোগ, নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের প্রভাব কাজ করেছে। ফলে তাদের অনুসারীরা ভালো পদ-পদবি পেয়েছেন।
দলীয় দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, কমিটি করা নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পরিষদ স্থায়ী কমিটির নেতাদের একটি বড় অংশ ছিল একেবারে অন্ধকারে। তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। কমিটি ঘোষণা সম্পর্কে স্বয়ং মহাসচিক মির্জা ফখরুল পর্যন্ত কিছুই জানতেন না। শনিবার সকালে চেয়ারপারসনের একজন লোক তার হাতে কমিটির তালিকা ধরিয়ে দেন, যা তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের একটি সূত্র জানায়, লন্ডন থেকে বিশেষ কয়েকটি পদের তালিকা আসে ঢাকায়। বাকিগুলো গুলশান অফিসে বসে করা হয়। লন্ডন থেকে যে তালিকা আসে তার অধিকাংশ কাটছাঁট করে ফেলে দেয়া হয় বা অবনমন করা হয়।
দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ ক’জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, আবদুল্লাহ আল নোমান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু, বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন এবং গত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান ও মিজানুর রহমান মিনু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম (নতুন কমিটিতে সদস্য), সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকার ও মশিউর রহমান, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক, সাবেক মহানগর সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির অর্থনৈতিক বিষয়ক আব্দুস সালাম, সহদপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনিসহ কয়েক নেতার নতুন কমিটিতে অবস্থান বা পদ-পদবি দেখে কর্মীরাও অসন্তুষ্ট বা ক্ষুব্ধ। এদের কয়েকজন তাদের ক্ষোভের কথা বলেছেনও।
তারেক রহমানের অভিপ্রায় সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শাহ্ মোয়াজ্জেমকে স্থায়ী কমিটিতে রাখা হয়নি।অথচ বিএনপির সাবেক মহাসচিব একেএম ওবায়দুর রহমান, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের মতো বড় নেতাও তার কর্মী ছিলেন। ১৯৬২ থেকে পরপর তিনবার ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন। নতুন কমিটি এবং ওতে তার অবস্থান বিষয়ে শাহ্ মোয়াজ্জেমের মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে দীর্ঘ ৪৫ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে পদোন্নতি না পাওয়ায় ‘চরম’ হতাশ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। তার ভাষায়, যেভাবে তাকে মূল্যায়ন করার কথা ছিল, তা তিনি পাননি। তিনি হতাশ হয়েছেন। নিজের হাতে তৈরি করা কর্মী এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, ‘এক সময়ে আমি যখন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক তখন অনেকেই দলের সদস্যও ছিলেন না। আমি যখন শ্রমিক দলের সভাপতি নজরুল ইসলাম খাঁন সাধারণ সম্পাদক। তারা আজ বড় বড় পদে। রাজনীতিতে এমনটা হয়। তবে নেতাকর্মীরা কষ্ট পেয়েছে। আমিও কষ্ট পেয়েছি। আমি হতাশ ও বিস্মিত হয়েছি। পদে থাকার ইচ্ছা আমার নেই।’
সিনিয়র নেতাদের অনেকের মতো দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানও ক্ষুব্ধ। তিনি বিবার্তাকে বলেন, যারা সৎ, ত্যাগী ও বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকেই নতুন কমিটিতে স্থান পাননি। এখানে সব চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে কমিটিতে জ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি। বর্তমান কমিটিতে অনেক গ্যাপ রয়ে গেছে। এটা একটা হতাশার বিষয় এবং যে কারণে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার পদ না পেয়ে রাজনীতি ছাড়ার চিন্তা করছেন কেউ কেউ।
বিবার্তা/বিপ্লব/জিয়া