দলের জাতীয় সম্মেলনে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ওপর। সাড়ে চার মাস সময় নিয়ে তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেন। সম্প্রতি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় স্থায়ী কমিটি, ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিল ও ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন।
কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যাশা ছিল দলের নেতাকর্মীরা এবার নতুন করে জেগে উঠবে। কিন্তুু হয়েছে উল্টো। পুরো দলের অবস্থা এখন টালমাটাল। বিদ্রোহের সুর চারদিকে। রাগে ক্ষোভে নয়াপল্টনের পার্টি অফিসে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক নেতাকর্মী।
বিএনপির রাজনীতি থেকে চির বিদায়ের চিন্তা করছেন অনেক নেতা। গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ ঝারছেন। ফেইসবুকে স্ট্যাস্টাস দিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছের লোকদের তীব্র ভাষায় গালমন্দ করছেন।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির তিনটি আলোচনা সভা ছিল। আর এসব আলোচনা সভায় পৃথকভাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন, বিগ্রে. জে. (অব.) হান্নান শাহ্ এবং ভাইস চেয়ারম্যান আজম খান উপস্থিত ছিলেন।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে তিনটি আলোচনা সভাতেই বক্তারা আলোচ্য বিষয় ছেড়ে বিএনপির নবগঠিত কমিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দলের কমিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটান বিএনপি চেয়ারপারসনের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত, জিয়া পরিবারের আশীর্বাদপুষ্ট মোসাদ্দেক আলী ফালু। এরপর পদত্যাগ করেন সহ প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম। সর্বশেষ গত বুধবার পদত্যাগ করেন সাবেক এমপি সালিমুল হক কামাল।
বিতর্কিত লোকদের স্থায়ী কমিটিতে ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে স্থান দেয়ার অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেছেন তিনি। পদত্যাগ পত্রে কাজী কামাল বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময়ের বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে, যিনি গ্রুপিং করে মাগুরা জেলা বিএনপিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন। স্থায়ী কমিটিতে এমন ব্যক্তিদের স্থান দেয়া হয়েছে যাদের সঙ্গে নিজের মানসম্মান ক্ষুন্ন করে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তাই তিনি কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করছেন।
কমিটিতে প্রত্যাশিত পদ না পেয়ে পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ও গোলাম আকবর খন্দকার। এছাড়া আরো অন্তত ২ ডজন কেন্দ্রীয় নেতা ক্ষোভে অভিমানে দল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও বেগম জিয়ার লন্ডন প্রবাসী পুত্র তারেক রহমান।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ‘এক নেতার এক পদ' এ সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়িত হলে ঘোষিত কমিটিতে কমপক্ষে ৪০টি পদ শূন্য হতে পারে। ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির শীর্ষ পদেও নিয়ে যাওয়া হবে নির্বাহী কমিটিতে পদ পাওয়া বেশ কয়েকজনকে। এর বাইরে ২৫টি বিষয়ভিত্তিক কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন আরো ৩০০ জনের মতো নেতা। সব মিলিয়ে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ নেতা নতুন করে পদ পেতে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, বিএনপির যে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তা নিয়ে দলের অনেক সিনিয়র নেতা ও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষুদ্ধ। অবশ্যই ক্ষুদ্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। অনেক জুনিয়রকে সিনিয়র পদে বসানো হয়েছে। যোগ্য নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এনিয়ে দলে ক্ষোভ রয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি স্থায়ী কমিটির আট নম্বর সদস্য ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে আমার ওপরে যাওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো নিচে নেমে গেলাম। তবে দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের রয়েছে ভিন্ন মত।
এ বিষয়ে বির্বাতাকে তিনি বলেন, বিএনপির সদ্যঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসাধ্য সাধন করছেন। যারা এই কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই সে ক্ষোভের অবসান ঘটবে।
তিনি বলেন, যতো দ্রুত জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ের কমিটিগুলো করতে পারবো, ততই অসন্তুষ্টি কেটে যাবে। কমিটি গঠন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কিছু কাজ দিয়ে মাঠে নামানো হবে। যারা অপেক্ষায় আছে তারা তাদের কাজ দিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী হবে। এখন যারা কমিটিতে আছে তারা হয়ত কেন্দ্রীয় দায়িত্বটা ছেড়ে জেলার দায়িত্ব নিতে চাইবে।
তিনি বলেন, সুযোগ অনেকগুলো সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামের দুই নেতা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে চলে গেছেন। তাদেরকে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুলোর অবসান ঘটবে, মান অভিমানের মধ্য দিয়ে নয়।
গয়েশ্বর রায় বলেন, এবার যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদেরকে বয়সের বিবেচনায় দেয়া হয়নি। নেতৃত্ব বয়স দিয়ে হয় না। কাজের মূল্যায়নে নেতৃত্ব দেয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, সামনের দিনগুলোতে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য সবাইকে খুশি রেখে কমিটি গঠন করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। তার প্রত্যাশা ছিল দলের কেন্দ্রের পদ পেয়ে ঝিমিয়ে পড়া বা নিস্ক্রিয় নেতারা আবারো সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত হবেন। এই প্রত্যাশা থেকে বিএনপির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কমিটি ঘোষণা করেন তিনি।
তবে বড় কমিটি দিয়ে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করা হলেও বেশির ভাগ নেতাই ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আবদুল্লাহ আল নোমনের মতো সিনিয়র নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে না রেখে সালাহউদ্দিন আহমেদের মতো জুনিয়র নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেয়ায় শাহ্ মোয়াজ্জেম এবং নোমান ও তার অনুসারীরা বেশ চটেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি। আর ত্যাগীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ।
বিএনপিতে শাহ মোয়াজ্জেমের মতো দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী ও সিনিয়র নেতা হাতেগোণা কয়েকজন। সবাই ভেবেছিল নিশ্চিত ভাবে এবার স্থায়ী কমিটিতে তাকে স্থান দেয়া হবে। কিন্তু কমিটিতে স্থান না পেয়ে তার পাশাপাশি তারেক রহমানও ক্ষুদ্ধ হয়েছেন বলে সূত্র জানায়।
এছাড়া প্রত্যাশিত পদ না পেয়ে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন, সাদেক হোসেন খোকা, আমান উল্লাহ আমান, গোলাম আকবর খন্দকার, নাজিম উদ্দিন আলম, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, মিজানুর রহমান মিনু, নাদিম মোস্তফা, জয়নুল আবদীন ফারুক, আবদুস সালাম, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, ডা. মাজহারুল ইসলাম, আবদুল লতিফ জনি, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদসহ অন্তত দুই ডজন নেতা।
এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, কমিটি নিয়ে কী বলবো বুঝতে পারছি না। ভাবছি, কী করা যায়। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। নেতাকর্মীরা আসছেন, আলোচনা করছেন। দেখি কী করা যায়।
তবে কমিটি ঘোষণার পর নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ ও অসন্তোষকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলের দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বেগম জিয়ার ঘনিষ্টজনদের মতে, নেতারা মনোক্ষুন্ন ভাব প্রকাশ অব্যাহত রাখলে ও বাড়াবাড়ি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং তারা পদও হারাতে পারেন।
এদিকে আবদুল্লাহ আল নোমানকে স্থায়ী কমিটিতে না রাখায় বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।
এছাড়া নগর বিএনপির সভাপতি না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আবু সুফিয়ানও। তার সমর্থকরা এর প্রতিবাদে মিছিলও করেছেন।
বিবার্তা/বিপ্লব/কাফী