আজকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিবো এমন কিছু সুন্দর অথচ বিষাক্ত প্রানীর সাথে, যাদের একফোঁটা বিষের সংস্পর্শে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। তো চলুন একে একে পরিচিত হওয়া যাক প্রাণীগুলোর সাথে।
বক্স জেলিফিশ: পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত প্রাণীর মুকুটটি পরে বসে আছে এই অদ্ভুত সুন্দর প্রাণীটি। দেখতে অপরূপ হলেও এটি সাক্ষাত মৃত্যুদূত। এর বিষ পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী। সাধারণত এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার সাগরে এদের দেখা মেলে। গভীর সমুদ্রে থাকলেও মাঝে মাঝে খাবারের সন্ধানে বীচের কাছাকাছি এসে পড়ে। তখন মানুষ এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এরা বেশিরভাগ সময়ে মানুষের পায়ে আক্রমণ করে বিষাক্ত হুল দ্বারা। এর বিষ মানুষের হার্ট, নার্ভ সিস্টেম এবং স্কিন সেলগুলোকে আক্রমণ করে এবং নষ্ট করে ফেলে। বক্স জেলি ফিশের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি প্রবলভাবে কাঁপতে থাকে এবং আস্তে আস্তে ডুবে যায় অথবা তীরে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়। আর যারা জীবিত থাকে তারা ব্যথা ও দুর্বলতা নিয়ে বেঁচে থাকে। যদি অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নেয়া হয় তাহলে বাঁচার কোনো আশাই থাকে না। এর বিষের সবচেয়ে ভালো প্রতিষেধক হচ্ছে ভিনেগার। বিষক্রিয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে (কমপক্ষে) ভিনেগার দিতে হবে। ভিনেগারে আছে অ্যাসিটিক অ্যাসিড যা জেলি ফিশের বিষকে রক্তে মিশে যেতে বাধা প্রদান করে এবং সেই সাথে ব্যথাও উপশম করে।

কিং কোবরা: শঙ্খচূড় বা কিং কোবরা, পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিষাক্ত সাপ, যার দৈর্ঘ্য হতে পারে ৫.৬ মিটার পর্যন্ত মানে প্রায় ১৯ ফিটের কাছাকাছি! এটি মূলত সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার বনাঞ্চল জুড়ে দেখা যায়। ইংরেজি নামে কোবরা শব্দটি থাকলেও এটি কোবরা বা গোখরা নয়। এটি সম্পূর্ণ আলাদা গণের একটি সাপ। এই সাপের আকার পর্যবেক্ষণ এবং ফণার পেছনের অংশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গোখরার সাথে এটির পার্থক্য খুব সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব। গোখরার তুলনায় শঙ্খচূড় আকৃতিতে যথেষ্ট পরিমাণ বড়। শঙ্খচূড়ের গণের নাম হচ্ছে Ophiophagus, যার আক্ষরিক অর্থ ‘সাপখাদক’, এবং প্রাথমিকভাবে এটি অন্যান্য সাপ ভক্ষণ করেই তার খাদ্য চাহিদা মেটায়। যে সব সাপ এটি ভক্ষণ করে তার মধ্যে আছে ছোট সাপ, এবং ছোট আকৃতির অজগর। এছাড়াও অন্যান্য বিষধর সাপও এটি ভক্ষণ করে, যেমন: ক্রেইট, গোখরা, এবং নিজ প্রজাতিভুক্ত অন্যান্য ছোট সাপ। এই সাপের বিষ মূলত নিউরোটক্সিক, অর্থাৎ এটির বিষ আক্রান্ত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে। শঙ্খচূড়ের একটি সাধারণ দংশন-ই যেকোনো মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এর কামড়ের ফলে মৃত্যুর হার প্রায় ৭৫%। বাংলাদেশের সুন্দরবনের গভীরে এই সাপ দেখতে পাওয়া যায়।
মার্বেলড কোন স্নেইল: বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ১০ বিষধর প্রাণীর মধ্যে অন্যতম এই মার্বেল কোনা শামুক। এর ইংরেজি নাম marbled cone snail বা Conus marmoreus। মাত্র ৬ ইঞ্চি লম্বা আর ৭-৮ গ্রাম ওজনের এই শামুক নানা রকম সামুদ্রিক কীটপতঙ্গ ও ছোট মাছ খেয়ে বাঁচে। লোনা পানির এই শামুক সর্বোচ্চ ৯০ মিটার গভীর পর্যন্ত যেতে পারে। দেখতে সুন্দর ও ছোট এই শামুকের বিষ এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যার এক ফোঁটা বিষ দিয়ে ২০ জন মানুষকে মারা যায়। যদিও এই শামুক তার বিষ তাদের শিকার ধরার কাজে ব্যবহার করে। এর দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হবার সাথে সাথে অথবা কয়েকদিন পরেও এর লক্ষণ দেখা যায়। যা তীব্র যন্ত্রণা, ফুলে যাওয়া, অনুভূতিহীন এবং ব্যথায় টন টন করা ইত্যাদি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মাংসপেশির সংকোচন, দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন এবং শ্বাসকষ্ট। এই বিষের কোন প্রতিষেধক নেই।
ব্লু রিংড অক্টোপাস: এই ব্লু রিংড অক্টোপাস আকারে অত্যন্ত ছোট, বড় জোর একটা গলফ বলের আকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু এর বিষকে মোটেও ছোট করে দেখলে হবে না। এটি যে পরিমাণ বিষ বহন করে সেটি দিয়ে ২৬ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে এক মিনিটের মাঝে মেরে ফেলা সম্ভব। এই বিষের কোন প্রতিষেধক নেই। এটির কামড় যন্ত্রণাহীন হলেও এর মারাত্মক নিউরোটক্সিক বিষ সাথে সাথে কাজ করতে শুরু করে। মাংসপেশীর অসাড়তা এবং গা গোলানো থেকে এর বিষের লক্ষণ শুরু হয় এবং পরিণামে মৃত্যু নিয়ে আসে। জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার শান্ত সমুদ্রে জোয়ারের সময় এদের দেখতে পাওয়া যায়।
ডেথ স্টকার স্করপিয়ন: বেশির ভাগ বিচ্ছু মানব জাতির জন্য ক্ষতিকারক নয়, যদিও এদের কামড়ের ফলে স্থানীয়ভাবে সামান্য ব্যথা, অনুভূতিহীনতা অথবা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। কিন্তু ডেথ স্টকার নামের বিচ্ছু মারাত্মক ক্ষতিকারক একটি প্রজাতি, যার বিষ সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এর হুলের বিষ এতটাই শক্তিশালী যে, অসহ্য যন্ত্রণা, জ্বর, অচেতনতা, মাংসপেশির প্রবল সংকোচন, অবশ এবং সবশেষে মৃত্যু ঘটায়। উত্তর আফ্রিকা এবং মিডল ইস্টে এই বিচ্ছু পাওয়া যায়।
স্টোন ফিশ: হয়তো বা পাথুরে মাছ কোন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জিততে পারবে না, কিন্তু ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত মাছ’-এর খেতাব নিশ্চিত জয় করতে পারবে। এর বিষের বিষক্রিয়া এতটাই তীব্র যে, আক্রান্ত ব্যক্তি যন্ত্রণায় দেহের অঙ্গ কেটে ফেলতে চায়। সমুদ্রের তলদেশে থাকা নানা রকম পাথরের ভাঁজে নিজেকে নিপুণভাবে আড়ালে করে রাখার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা এবং পাথরের ছদ্মবেশ ধারণ করে সবার চোখকে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার কারণে এই প্রাণীটিকে ছদ্মবেশীদের গুরু বলে অনেকেই আখ্যায়িত করে থাকেন। এই প্রাণীর শরীরে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে বিষাক্ত কাঁটা এবং এই বিষাক্ত কাঁটা হাঙ্গর ও অন্যান্য লুন্ঠনকারী, অনিষ্টকারী প্রাণীর হাত থেকে তাকে রক্ষা করে। এই কাঁটার আঘাতে ভিকটিমের হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর দ্রুত নিস্তেজ হয়ে আসে। আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা বিলম্বিত হলে তাকে আর বাঁচানো যায় না। পাথুরে মাছ গ্রীস্মমণ্ডলীয় দক্ষিণাংশে বাস করে, কদাচিৎ ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর থেকে কুইন্সল্যান্ড পর্যন্ত বিশাল শৈল প্রতিবন্ধকের শান্ত অগভীর পানিতে দেখা যায়।
ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারিং স্নাইপার: ২০০৭ সালের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে বিষধর মাকড়সা যা বেশিরভাগ মানূষের মৃত্যুর কারণ। অন্যান্য মাকড়সার চেয়ে এই মাকড়সা অধিক শক্তিশালী বিষ (একটি ইঁদুর মারতে মাত্র ০.০০৬ মিলিগ্রাম যথেষ্ট) নিয়ে বেঁচে থাকে। তাদের আশ্চর্য স্বভাবের কারণে তারা অতি ভয়ংকর। তারা সাধারণত দিনের বেলায় জনাকীর্ণ এলাকায়, বাসগৃহে, কাপড়ে, জুতোর ভেতরে, গাড়িতে লুকিয়ে থাকে। এটার বিষে শুধু তীব্র যন্ত্রণাই করে না-কয়েক ঘণ্টার জন্য অস্বস্তিকর লিঙ্গোউত্থান করে যা পরবর্তীতে নপুংসকতার দিকে ঠেলে দেয়।
ইনল্যান্ড তাইপে: ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ’ এর খেতাব আন্তঃর্দেশীয় (অভ্যন্তরীণ/স্থলভাগের) তাইপের। যার একটা মাত্র ছোবলে ১০০জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ অথবা ২,৫০,০০০ সংখ্যক দলের ইঁদুর নিধন করার জন্য যথেষ্ট। এর বিষে সাধারণ কোবরা থেকে ২০০ থেকে ৪০০ ভাগ বেশি পরিমাণ টক্সিন থাকে যা মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে মারতে সক্ষম। যদিও এই প্রজাতির সাপ খুবই লাজুক প্রকৃ্তির এবং কোথাও এর দ্বারা সংঘটিত মানুষের প্রাণনাশের মত বিপর্যয়ের কোন রেকর্ড নেই।
প্রিজন ডার্ট ফ্রগ: মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার রেইন ফরেষ্ট গুলোতে সুন্দর ও বিভিন্ন রঙের নীলাম্বরী ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্যতম বিষাক্ত প্রাণিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুই ইঞ্চি (৫ সেমি) লম্বা এই জাতীয় ব্যাঙ, যার বিষ ১০জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ অথবা ২০,০০০ ইঁদুরকে মারতে সক্ষম। বিষধর ব্যাঙের তালিকায় রয়েছে কালো কানের ব্যাঙ, কালো পেয়ে ব্যাঙ, করোবোরি ব্যাঙ ও স্ট্রবেরি ব্যাঙ। এদের মাত্র দুই মাইক্রোগ্রাম প্রাণঘাতী বিষ একজন মানুষ বা বৃহৎ কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়ে সিনেমায় হয়তো অনেকেই দেখেছেন, তারা বাঁশের মতো চিকন পাইপে ফুঁ দিয়ে তীর ছুঁড়ে শিকার করে। এই পাইপকে বলে ‘ব্লো পাইপ বা ব্লো গান’ আর তীরটাকে বলে ‘ডার্ট’। আবার রংধনু ব্যাঙ, সোনা রঙা ব্যাঙ, সবুজ, কালো ব্যাঙ, হলুদ ডুরে ব্যাঙ আর বলিভিয়ান ব্যাঙও মারাত্মক বিষাক্ত। এদের এই তীরের ডগায় বিষ মাখানো থাকে। আর এই বিষ আসে বিষধর ব্যাঙের পিঠ থেকে। তার জন্যে ব্যাঙ মারতেও হয় না। কেবল সেই বিষধর ব্যাঙের পিঠে ডার্টের মাথাটা ঘষে নিলেই হয়। সেই থেকে এই ব্যাঙগুলোর নাম হয়ে গেলো প্রিজন ডার্ট ফ্রগ বা প্রিজন অ্যারো ফ্রগ।
ফোটকা মাছ: পৃথিবীর বিষাক্ত প্রাণীদের মধ্যে দ্বিতীয় বিষাক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণী হচ্ছে এই মাছ। জাপানে এটি ফুগু নামে এবং কোরিয়ায় বুক-উহ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এটি পটকা মাছ নামে পরিচিত। এই মাছ উপাদেয় খাবার হিসেবেও বিশেষ পরিচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর চামড়া এবং ভেতরের কিছু অংশ, যা খুবই বিষাক্ত। এই প্রাণীটি তার অনিষ্টকারীর উপস্থিতি বা বিপদ আঁচ করতে পারলে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গ্লোব বা ফুটবল আকার ধারণ করে এবং টেট্রোডক্সিনা যা কিনা সায়ানাইডের চেয়ে ১০০০ গুণ শক্তিশালী এমন বিষাক্ত পদার্থ আক্রমণকারীর উপর নিক্ষেপ করে। এই মাছের বিষক্রিয়ায় খুব দ্রুত এবং ভয়ংকরভাবে মৃত্যু হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি জিহবা ও ঠোটের অসারতা, মাথা ঘোরানো, বমি, মাংশপেশির অবশ হওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এবং যার কোন জানা প্রতিষেধক নেই। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জাপানে প্রতি বছর ২০ থকে ৪৪ জন ফোটকা মাছের বিষক্রিয়ার স্বীকার হয় এবং তন্মধ্যে ৬ জনের বেশি মৃত্যু হয়। আর বাংলাদেশে পেপার খুললেই তো দেখা যায় পটকা মাছ খেয়ে অমুক পরিবারের অত জনের মৃত্যু।
বিবার্তা/জিয়া