রাজধানীতে দূষিত পানির রমরমা বাণিজ্য

রাজধানীতে দূষিত পানির রমরমা বাণিজ্য
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ০৯:১০:২০
রাজধানীতে দূষিত পানির রমরমা বাণিজ্য
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+
বোতলজাত পানির দাম বেশি হওয়ায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি অত্যন্ত কম দামে বেশি পানির লোভ দেখিয়ে রাজধানীজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে প্লাস্টিক কনটেইনার ভর্তি পানির রমরমা বাণিজ্য। এক ধরনের অস্বচ্ছ ও প্লাস্টিকের কনটেইনারে ভর্তি করে ‘মিনারেল ওয়াটার’নামে বিক্রি করা হচ্ছে এ দূষিত পানি। 
 
ঢাকা ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় অনেক নগরবাসী বাসাবাড়িতে এ পানি কিনে খাচ্ছেন। এ ছাড়া রাস্তার ফুটপাথে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোতেও এক গ্লাস এক টাকা মূল্যে এ পানি বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্কুল-কলেজ, বেকারি, ফাস্টফুডের দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাহিদামতো এ পানি সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে এ ব্যবসায় করা হচ্ছে। যারা এ পানির ব্যবসা করছেন, তাদের বেশির ভাগেরই নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স। 
 
অভিযোগ রয়েছে, জারের পানি আদৌ পরিশোধন করা হয় না। সরাসরি ওয়াসার সাপ্লাই করা পানিতে ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে তা কনটেইনারে ভরে বাজারজাত করা হয়। বিএসটিআই, জেলা প্রশাসন ও র্যা ব মাঝে মধ্যেই এর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে। কখনো কখনো পাঠানো হয় জেলখানায়। কিন্তু এ ব্যবসায় ক্রমান্বয়ে এতটাই লাভবান হয়ে উঠেছে যে জেল-জরিমানার পরও তারা আরো বেপরোয়াভাবে অবৈধ এ ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে। 
 
রাজধানীতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নলকূপ বসানোর সুযোগ নেই। ঢাকা ওয়াসা দুই দশক আগে রাজধানীর বিভিন্ন মোড় থেকে বিনামূল্যে পানি সরবরাহের কলগুলোও তুলে নিয়েছে ওয়াসা। নগরবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ওয়াসা, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তারা সফলতা দেখাতে পারেনি। নদীর পানি বিশুদ্ধ করে গ্রাহকদের সরবরাহ করলেও পানিতে দুর্গন্ধ থেকে যাচ্ছে। 
রাজধানীতে দূষিত পানির রমরমা বাণিজ্য
আগুনের তাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোটানোর পর সে পানি কোনো রকম পানযোগ্য হলেও দুর্গন্ধ যাচ্ছে না। এ কারণে অনেক নগরবাসী মিনারেল ওয়াটারের নামে জারের পানি কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ সুযোগে এলাকার অলিগলিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অবৈধ কোম্পানি, যারা বাসাবাড়ি, দোকান-হোটেলে এ পানি পৌঁছে দিচ্ছে। 
মোড়ে মোড়ে বিনামূল্যের কল চালু থাকার সময় নগরবাসী গরমে স্বস্তি পেতে হাতমুখ ধুতে পারত, মেটাতে পারত তৃষ্ণা। কিন্তু ওই সব পানির লাইন থেকে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বস্তিতে অবৈধ সংযোগ নেয়ার অভিযোগে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে পানি সরবরাহ পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় পথচলা মানুষ বাধ্য হয়েই নিরাপদ ভেবে পান করছে ফুটপাথের ‘ফিল্টারড পানি’। 
 
ফকিরাপুল মোড়ে ফুটপাথে আজিবর শেখের চায়ের দোকানে আদা-চায়ের পাশাপাশি ‘ফিল্টার পানি’বিক্রিও বেশ জমজমাট। এই চা বিক্রেতা জানান, ছাত্রছাত্রী ও রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সব ধরনের পথচারী তার ‘ফিল্টার পানির’ক্রেতা। প্রতি গ্লাস পানির দাম মাত্র এক টাকা। আর কোম্পানির কাছ থেকে তিনি ২০ লিটারের বড় জারভর্তি পানি কেনেন ৪০ টাকায়। দিনে তার বিক্রি হয় তিন-চার জার পানি।
 
ওই দোকানের ‘ফিল্টার পানির’জারগুলো আদৌ মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) অনুমোদিত নয়। এ ছাড়া জারগুলোর গায়ে কোনো কোম্পানির নাম বা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখও উল্লেখ নেই।
 
শুধু আজিবর শেখের এ দোকানই নয়, রাজধানীর ফুটপাথের দোকান ও মাঝারি মানের রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা ‘ফিল্টারড পানির’ ৮০ শতাংশই পরিশোধিত নয় বলে বিএসটিআই কর্মকর্তাদের অভিমত। 
 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে শতাধিক প্রতারকচক্র ওয়াসার পানি সরাসরি জারে ভরে এগুলো ‘ফিল্টারড পানি’হিসেবে বিক্রি করছে। মাত্র ৬০০ টাকার পাঁচ হাজার লিটার ওয়াসার পানি প্রতারকচক্র বিক্রি করছে ছয় থেকে দশ হাজার টাকায়।
 
বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক (সিএম) নূরুল আমিন জানান, বর্তমানে দেশে মাত্র ২৪৭টি কোম্পানি বিএসটিআই থেকে অনুমোদন নিয়ে বোতলজাত ও জারে করে পানির ব্যবসা করছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাতে রয়েছে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। বিএসটিআই থেকে এ পর্যন্ত ৩৬৭ কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, বাকিদের মধ্যে কারো মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে কিংবা বাতিল হয়ে গেছে। 
 
নুরুল আমিন বলেন, রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে জার পানির ব্যবসায় করছে। এদের ধরতে র্যা ব, জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। 
 
এত অভিযানের পরও কেন অবৈধ পানির ব্যবসায় বন্ধ করা যাচ্ছে না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কতগুলো নিয়ম মেনে জারে পানিভর্তি করে বিক্রি করতে হয়। সে জন্য প্রথমত বিএসটিআইয়ের অনুমোদন থাকতে হবে। একজন রসায়নবিদ ও পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকতে হবে। যেসব কর্মী জারে পানিভর্তি করবেন, তাদের সুস্বাস্থ্যের সনদ থাকতে হবে। লেবেল, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ করতে হবে। একটি মানসম্পন্ন সুপেয় পানি তৈরির কারখানায় মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা করা জরুরি। এ পরীক্ষা করা না হলে পানিতে ডায়রিয়া, কলেরা ও টাইফয়েডসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের জীবাণু থেকে যেতে পারে। এ ছাড়া পুনর্ব্যবহৃত (রিসাইকেলড) জারগুলোকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হয়। 
 
তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিটি কারখানায় জার পরিষ্কার যন্ত্র থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব না থাকলে তাদের লাইসেন্স দেয়া হয় না। এ ছাড়া বৈধভাবে পানির ব্যবসায় করতে হলে কমপক্ষে ২০-২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। অনেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় শুরু করে দেন। পরে জরিমানা-জেল দিলেও তারা আবার ওই ব্যবসায় চালাতে থাকেন। নুরুল আমিন মনে করেন, জনগণের মধ্যে সচেতনতা ছাড়া শুধু অভিযান চালিয়ে অবৈধ এ ব্যবসায় বন্ধ করা সম্ভব নয়। 
 
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে বর্তমানে মাত্র ৩৫টি কোম্পানির ওয়াসার পানি ব্যবহারের লাইসেন্স রয়েছে। 
ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেজর (অব:) ডা: আনোয়ার হোসেন বলেন, পানিতে ক্ষতিকর উপাদানগুলোর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিতে টাইফয়েড জাতীয় রোগ, ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, জণ্ডিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে। 
 
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, পিএইচ ভ্যালু ৬.৫-এর নিচে নেমে গেলে পানিতে অ্যাসিডিটি বেড়ে যায়। এতে মাড়িতে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। যদি কেউ লেড ও ক্যাডমিয়ামযুক্ত পানি নিয়মিত পান করে এবং তা অভ্যাসে পরিণত হয় তাহলে তার শরীরে পুষ্টির অসমতা দেখা দিতে পারে।
 
বিবার্তা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com