দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আর জাতীয় মর্যাদার প্রতীক হল জাতীয় পতাকা। ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার ইতিহাস নিয়ে পাঠ্য বইয়ে যা নেই, তা আছে আসানসোলের কালীশঙ্কর বাবুর কাছে। জীবনের ৭৮টি বসন্ত পার করে ডক্টরেট হয়েছেন কালী শঙ্কর ভট্টাচার্য্য। প্রাক্তন রেল কর্মী কালীবাবু থাকেন আসানসোলের গোপালপুরে।
সারা বিশ্বের পতাকা নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। দেশ বিদেশের জাতীয় পতাকা, ধর্মীয় পতাকা, রাজনৈতিক পতাকা মিলিয়ে ৪২২টি পতাকার ইতিহাস ও সন্ধান রয়েছে তাঁর গবেষণা ধর্মী রিপোর্টে। যা দেখে চমকে গেছেন দেশের ঐতিহাসিকরাও। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পতাকার মতো বিষয় নিয়ে প্রথম গবেষণা করে ডক্টরেট হয়েছেন। ভারতের জাতীয় পতাকার প্রস্তাবিত ও গৃহীতরূপ নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি। ভারতবর্ষের প্রস্তাবিত ও উত্তোলিত জাতীয় পতাকার বিবর্তন হয়েছে ১৭ বার। গবেষণার সেই মডেল পতাকাগুলি সংরক্ষিত রয়েছে কালীশঙ্কর বাবুর কাছে।
ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। ‘জাতীয়’ কথাটির উদ্ভবও হয় সেই প্রথম। সাদা বর্গাকার পতাকার মাঝে ছিল রক্তিম সূর্য। লহৌর নিবাসী শিরিষ চন্দ্র বসু কতৃক এই পতাকাটি প্রস্তাবিত হয়। যিনি পানিনি অফিসে কাজ করতেন।
১৯০৫ সালের ৭ আগষ্ট জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলিত করেছিলেন অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিষ্টার প্রমথ নাথ মিত্র। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার পার্সী বাগান স্কয়্যারে সেই পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল। ওই একই দিনে কলকাতার স্বদেশী আন্দোলনকারিরা ধর্মতলা পার্কে গর্ভনর হাউসের সামনে গোপনে পতাকাটি উত্তোলন করেন। পতাকার রং ছিল ত্রিবর্ণ।
উপরে লাল, মাঝে হলুদ নীচে সবুজ। লালের উপর আঁকা অষ্টবৃন্তের আটটি কুসুম। হলুদের উপর সংস্কৃতে লেখা বন্দেমাতরম। সবুজের উপর সূর্য ও অর্ধচন্দ্র। ওই একই আদলে চার রকমের পতাকার বিবর্তন হয়। মেদিনীপুরের স্বদেশী আন্দোলনকারীরা যে পতাকাটি প্রস্তাবিত করেছিলেন তা ছিল লাল, হলুদ ও নীল। আর বাংলায় লেখা বন্দেমাতরম। ব্রিটিশ শাসনে আটটি প্রদেশকে চিহ্নিত করতে কখনও প্রস্ফুটিত পদ্ম, কখনও অষ্ট কুসুমকে পতাকার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
১৯০৬ সালে বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর সমিতি পার্টি কংগ্রেসে যে পতাকাটি প্রস্তাব করেছিল সেটি ছিল লাল রঙের। ঋষি অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্র নাথ দত্তের প্রস্তাবিত পতাকাটি দেখতে ছিল তলোয়ার ও ত্রিশূলের গুনিতক আকার। উপরে চাঁদ ও নীচে চক্র।
দেশের বাইরে প্রথম প্রস্তাবিত ও গৃহীত জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন এক ফরাসী নাগরিক মাদাম কামা। ১৯০৭ সালের ২২ অগস্ট জার্মানির স্টুর্টগার্ডে আর্ন্তজাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে ওই পতাকাটি উত্তোলিত হয়। কালী বাবুর গবেষণা রিপোর্ট বলছে, ওই পতাকার নাম ‘সপ্তর্ষি পতাকা’। উপরে লাল, মাঝে হলুদ ও নীচে সবুজ। গৈরিকে উপর আঁকা একটি কুসুমের সঙ্গে সাতটি তারা। মাঝে বন্দেমাতরম লেখা, ও নীচে সবুজের উপর সূর্য-চন্দ্র।
১৯০৯ সালে ভগিনী নিবেদিতা প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকাটি ছিল লাল রঙের। পতাকার মধ্যে বজ্র কুসুম দন্ড। তার মধ্যে লেখা বন্দেমাতরম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেই পতাকাটির ছবি ছাপা হয়। যেহেতু দধিচির হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি হয়েছিল তাই তিনি বজ্রকে ত্যাগের প্রতীক বলে মনে করতেন। আর ভারতবর্ষের মানুষের মন কসুমের মতো।
১৯১৬ সালে লোকমান্য তিলক ও অ্যানি ব্যাসন্ত হমরুল লীগে যে জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন সেটি লাল সবুজ স্ট্রাইপের। উপরের বাম কোনে ইউনিয়ন জ্যাকের সিম্বল। পতাকার মাঝে সপ্তর্ষি ও চাঁদ। এটি পঞ্চকোনি, অর্থ্যাৎ পাঁচ কোণের পতাকা। বেশ কয়েক বছর এটি উত্তোলিত হয়েছিল।
১৯২২ সালে বিজয়ওয়াড়ায় কংগ্রেস কমিটি মিটিঙে, মহাত্মা গাঁধীর উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেখানে ঠিক হয় জাতীয় পতাকায় কোন জাতীয় চরিত্রকে চিহ্নিত করা হবে। পিঙ্গোলি ভেঙ্কাইয়া নামক এক ছাত্র একটি পতাকা তৈরি করে নিয়ে আসেন, যার উপরে লাল নীচে সবুজ ও মাঝে চরকা।
পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২৩ সালে, কংগ্রেস কমিটির মিটিঙে ওই লাল-সবুজ পতাকাটি উল্টে দেওয়া হয়। পরিবর্তে নীচে লাল, উপরে সবুজ ও তার উপর সাদা ও মাঝে চরকা আঁকা হয়। এই প্রথম সর্বধর্ম সমন্বয়কে মাথায় রেখে জাতীয় পতাকা তৈরি হয়। তৈরি করেন গাঁধীজী। লাল এখানে বৃহত্তর হিন্দু ধর্ম, যারা সমস্ত ধর্মকে বহন করবে, তাই নীচে। উপরে সবুজ, মানে মুসলিম সম্প্রদায়। তার উপরে সাদা, মানে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ১৯২৩ থেকে, ৩০ সাল পর্যন্ত এই পতাকাটি উত্তোলিত হয়।
১৯৩১ সালের ৬ অগষ্ট জাতীয় পতাকার রং পরিবর্তিত হয়— উপরে গৈরিক, মাঝে সাদা, নীচে সবুজ, মাঝে চরকা। ১৯৪৭ সালের ২২ অগষ্ট চরকার পরিবর্তে সারনাথে যে অশোক চক্রটি রয়েছে, সেই ২৪ স্পোকের চক্রটি নীল রঙে আঁকা হয়। অশোক চক্রটি নেওয়ার অর্থ অশোক বিশ্বজয় করেও অহিংসার পথ বেছে নিয়েছিলেন—জওহরলাল নেহেরুর পছন্দ হয়েছিল এই ভাবনাটি।
পতাকা নিয়ে যার এই গবেষনা সেই কালীশঙ্কর বাবুর জন্ম বাংলাদেশে হলেও, কলকাতা চলে আসেন ১৯৪৮ সালে। প্রচন্ড দারিদ্রতা নিয়ে পড়াশুনা। অর্থাভাবে হোটেলে কাপ-প্লেট ধুয়েছেন। বঙ্গবাসী কলেজে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে চাকরি পান আসানসোলের রেলে। কালী বাবুর জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসার বুঝতে পেরে রেলের স্কুল পরিদর্শন কমিটিতে নিয়ে আসা হয় তাঁকে।
ছোটবেলায় বাবার একটি ডায়েরিতে কয়েকটি দেশের পতাকা দেখে উৎসাহ জাগে। পড়াশুনা চলাকালীন বিভিন্ন পতাকা নিয়ে গবেষনা শুরু করেন। এমনকি চাকরি জীবনেও পতাকার গবেষণা চালিয়ে যান। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর, ২০০৮ সালে প্রথম গবেষণার রিপোর্টটি জমা দেন। ২০১০-এ, তৎকালীন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন তাঁকে পুরস্কৃত করেন ও পি এইচ ডি প্রদান করেন।
এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। বর্তমানে, ৮৪ বছর বয়সেও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কালী স্যার। তাঁর গবেষণার বিষয় এখন অশোক চক্র। দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছেন কালীশঙ্কর বাবু। কিন্তু এই রাজ্যে তার কদর নেই। আজও মেলেনি কোন সরকারি সম্মান। ২৬ জানুয়ারি তিনি পতাকা তুলেন পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে। কিন্তু তাঁর ঠাঁই হবে না কোন সরকারি মঞ্চে। আক্ষেপ এটাই। সূত্র : এবেলা।
বিবার্তা/এম হায়দার