মতিহারের সবুজ চত্বরকে কেমন যেন সবুজ মনে হলো না শুক্রবার রাতে। সবুজের উচ্ছাসও চোখে পড়লো না বিন্দুমাত্র। একটু অন্ধকার ছিলো বটে, কিন্তু প্যারিস রোডকে তো এতো বেশি কালো দেখায়নি কখনো। রাত ৯টার এ সময়টা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেকটা মুখরিতই করে রাখেন ক্যাম্পাস। কিন্তু শুক্রবারের রাতের চিত্রটা আলাদা! সমস্ত বিষাদের আঁধার যেন আসন পেতেছে এই মতিহারে।
মতিহার ছাপিয়ে এই বিষাদ প্রকাশিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। সাবেক শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে থেকে ফেসবুকের ওয়াল ভরছেন মতিহারকে ঘিরে। আর বর্তমান শিক্ষার্থীরাও সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে ফেসবুকে লিখছেন প্রিয় শিক্ষক আকতার জাহান জলিকে নিয়ে। তাদের লেখা বলছে, তারা শোকাহত, তারা মর্মাহত, তারা নির্বাক, তাদের হৃদয় যেন বেদনায় লীন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী যমুনা টেলিভিশনের বগুড়া ব্যুরো প্রধান মেহেরুল সুজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পরীক্ষার হলে যতোবারই ম্যাডাম পরিদর্শক হিসেবে থাকতেন, অতিরিক্ত খাতা আনতে গেলেই বলতেন, ‘মেহেরুল, তুমি যেন এখন কোন কাগজে কাজ করছো?’ আমি হাসিমুখে সব বারেই বলতাম, ‘ম্যাডাম, সমকাল-এ কাজ করি।’ ম্যাডাম হেসে বলতেন, ‘ও, ভুলে যাই শুধু।’ এমন অসংখ্য স্মৃতি আকতার জাহান ম্যাডামের সাথে। কয়েক মাস আগেও আমাকে ফোন করে আমাদের বন্ধু ওয়াহিদা সিফাতের হত্যা মামলার খোঁজখবর নিলেন ম্যাডাম। আর এখন তার অপমৃত্যুর খবর নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আমার রাজশাহীর সহকর্মীরা। ভাবতেই কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করছি চারপাশে।’
প্রিয় শিক্ষককে হারানোর শোকে ফেসবুকে কালো একটি ছবিকে প্রোফাইল পিকচার বানিয়েছেন বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের রাবি প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম। তার ছবিতে শুধু কালো আর কালো, আর কিছু নেই। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আর পারছি না। মাথা কাজ করছে না। ম্যাম আমাদের রিপোর্টিং পড়াতেন। শিখিয়েছেন কীভাবে কারো মৃত্যু সংবাদ লিখতে হয়। আজ তারই মৃত্যু নিয়ে লিখতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে তার কক্ষে পাওয়া সুইসাইড নোট নিয়ে। না না। এ সত্য নয়। দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্লিজ কেউ বলেন সত্য নয়, স্বপ্ন দেখছি।’
আরেকটি স্টাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘লাশকাটা ঘরে ফেলে এসেছি আপনার দেহ। কিন্তু ফেলতে পারি নি আপনার স্মৃতি। ম্যাম, আপনি স্বার্থপর। হিম ঠান্ডায় কেমন চুপটি করে ঘুমাচ্ছেন। আমরা ঘুমাতে পারছি না। আপনার স্মৃতিগুলো কষ্ট দিচ্ছে। ম্যাম সবাইতো আপনাকে জানে না। ওরা কত কটূকথা বলবে। আপনার তো এটা প্রাপ্য ছিল না। আপনার মতো মানুষদের এভাবে যেতে হয় না। আপনি বোঝেন না? মায়ের অকাল মৃত্যুতে সন্তানদের অবস্থা কেমন হয়। তখন আমাদের কথা মনে হয়নি? একটুও মিস করেননি? না জানি কত কষ্ট পেয়ে আমাদের কথা ভুলে চলে যেতে বাধ্য হলেন। ভাবতে পারছি না।’
ঈদের ছুটিতে বাসায় এসেছেন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এনটিভির স্টাফ রিপোর্টার আরাফাত সিদ্দিকী। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে ছুটে গেছেন জুবেরি ভবনে। পরে রাতে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যার লেখা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ডে দেখেছি, ইনকোর্স পরীক্ষার খাতাতে আমার ভুলগুলোর পাশে যিনি সুন্দর করে মন্তব্য লিখতেন, যা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম, সেই হাতের লেখা দেখলাম আজ অনেকদিন পর, একটি 'সুইসাইড নোটে'। গত তিন বছর তিনি ছিলেন একদম একা, থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে শুয়ে শুয়েই তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, কোথাও তার কেউ নেই..একটু আগে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তার সেই রুমের সামনে, এখন সবাই এসেছেন এখানে, কত মানুষ, কত তাঁর পরিচিতজন, রুমের ভেতরে পুলিশের তদন্ত দল! আর তিনি এখন আছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে। বিকেল থেকে কিছু ভাবতে পারছি না, ম্যাডামের মিষ্টি হাসিটা শুধু মনে পড়ছে, 'ভালো আছো আরাফাত?’
বিভাগের শিক্ষার্থী প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি মাহবুব আলম লিখেছেন, ‘আপনি তো অনেক যত্ন করেই রিপোর্টিং শেখাতেন ম্যাম; তারপরও কেন আজ আপনার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে হাতটা কাঁপছিল, কেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল? রিপোর্টিং শিখিয়ে কী আজ সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা নিলেন আপনি? পরীক্ষার হলে তো এসে বলতেন, 'মাহবুব, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে।' তবে আজ কেন জিজ্ঞেস করলেন না ম্যাম? কেন শিখিয়ে গেলেন না 'মানসিক চাপ' কতটা হলে একজন মানুষ 'আত্মহত্যা' করতে পারে? সেই মানসিক চাপটা কীভাবে বর্ণনা করতে হয়?’
বিভাগের শিক্ষার্থী বহ্নি মাহবুবা লিখেছেন, ‘ক্লাসরুমে আমাকে বলা তার প্রথম কথা ছিল- বহ্নি, কিছু খাওয়া দাওয়া কর...এই শরীর নিয়ে সাংবাদিকতা কেমনে করবা? ভাইভা বোর্ডে কোন একটা প্রসঙ্গে বলেছিলেন,-যে অন্যায় করে তাকে কী সাপোর্ট দেয়া উচিত? এই যে আপনি অসময়ে চলে গেলেন এইটা অন্যায় না? খুব অন্যায়। মানতে পারছি না। গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে উঠছে।’
প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে তার সাবেক-বর্তমানের অগণিত শিক্ষার্থী রাত জেগে ফেসবুকে এমনই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজশাহীতে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরাও অধ্যাপক আকতার জাহানকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তারা কেউই আকতার জাহানের এমন চলে যাওয়া মানতে পারছেন না। তারা বলছেন, এমন ঘটনা শুধু অনাকাঙ্খিত নয়; রীতিমতো বিস্ময়ের। যা বিশ্বাস করা যায় না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলি। শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে কক্ষের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কক্ষটির দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল। ওই কক্ষে আকতার জাহানের হাতে লেখা ‘অস্বাক্ষরিত’ একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কয়েক বছর আগে স্বামী তানভীর আহমদের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে আকতার জাহানের। তার সাবেক স্বামী তানভীর আহমদও রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বিভাগের সাবেক সভাপতি তানভীর আহমদ দ্বিতীয় বিয়ে করে ক্যাম্পাসের আলাদা একটি কোয়ার্টারে থাকেন। অন্যদিকে জুবেরি ভবনের এই কক্ষে একাই থাকতেন আকতার জাহান। স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
সুইসাইড নোটে তিনি তার সাবেক স্বামীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম। সোয়াদকে (ছেলে) যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে- সে যে কোনো সময় সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।’
বিবার্তা/রিমন/ইফতি