খোকন ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বিজনেস অনুষদের মেধাবী ছাত্র। সদা হাস্যোজ্জ্বল,তীক্ষ্ণ দূরদর্শী সস্পন্ন ছাত্রনেতা। সব সময় একটা আফসোস করে বলতেন- হিমু আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি সব সময়, শুধু প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই গেলাম। কত ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা যায় বল।
কিছু শক্তিশালী ছাত্রনেতার নাম বলে খোকন ভাই বলতেন- বল, এরা যদি সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধাচরণ করে তবে কিভাবে রাজনীতিটা করবো। একমাত্র খোকন ভাই বলেই সম্ভব হয়েছিল, এত সবের পরেও রাজনীতির মাঠে একজন নীতি নির্ধারক ভূমিকায় টিকে থাকা।
ব্যক্তিগতভাবে খোকন ভাইয়ের সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক, এটা সবার জানা। বাহাদুর ভাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। আমি তার হল শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র। এটা আমার জন্য একটা বড় আশীর্বাদ ছিল। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়ে হলে উঠি, তখন বাহাদুর ভাই, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বাহাদুর ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা অত্যন্ত শ্রদ্ধার। আমি তাকে অনেক অনেক সম্মান করি এবং তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করেন, যেটা এখনো চলমান।
ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত ছিলেন বা আছেন, তারা সহজেই বুঝবেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হল রাজনীতি কত কঠিন। কতশত প্রক্রিয়া এখানে কাজ করে। টিকে থাকতে হলে এখানে কত কিছু ম্যানেজ, মোকাবেলা করতে হয়। ক্ষমতাসীন দলে তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা খুব সহজ কাজ ছিল না। কথায় কথায় তাই বলা হয়, কেউ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হল শাখার নেতৃত্ব দিয়ে থাকে, তাকে আর পরবর্তীতে রাজনীতির খুব কম শিক্ষা নিতে হয়। যে রাজনৈতিক শিক্ষা ওখানে অর্জন করে সেটা অনেকেরই থাকে না।
১৯৯৮ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি বাহাদুর ভাই এবং সাধারণ সম্পাদক খোকন ভাই। আমি তখন শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের ১ম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ক্ষমতাসীন দল, হল সম্মেলন শুরু হলো। আমি স্বভাবতই এই হলের প্রার্থী। এ এক কঠিন বাস্তবতা আমার জন্য। কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ক্যাম্পাসে আরো অনেক নীতিনির্ধারণী বলয় ছিল। যাদের ম্যানেজ করে তখন রাজনীতি করতে হয়।
শহীদুল্লাহ হলে নেতৃত্বের জন্য মোটামুটি আমি এবং আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু বিপ্লবের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা। ক্যাম্পাসের সবাই বুঝতে পারতো আমরা দুইজনই এই হলের নেতৃত্বে আসছি। আমি চাইতাম সভাপতি হবো এবং বিপ্লব সাধারণ সম্পাদক হবে। কিন্তু ও চাইতো ঠিক উল্টোটা।
এই প্রক্রিয়া নিয়ে যখন আমি ব্যস্ত, তখন হঠাৎ শুনলাম আমার আরেক বন্ধু জুয়েলও প্রার্থী এবং খোকন ভাইসহ ক্যাম্পাসের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বলয় ওকে সমর্থন করছে।
বিপ্লব বলতে লাগলো বাহাদুর ভাই আমাকে সমর্থন করবে। আর জুয়েল বলতো খোকন ভাই আমাকে বানাবে। তখন আমার খুবই শোচনীয় অবস্থা। কিন্তু আমার সাহস ছিল যে, হলের ৯০% কর্মী আমাকে সমর্থন করবে।
খোকন ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম, তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললাম ভাই, কী শুনছি। আপনি আমাকে না চেয়ে জুয়েলকে চাচ্ছেন। খোকন ভাইয়ের চোখে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অনেকক্ষণ চুপ আমরা। কিছুক্ষণ পর খোকন ভাই কী যেন চিন্তা করে বললো, শোন মন খারাপ করিস না, আমি হয়তো অনেক কারণে তোর নাম প্রস্তাব করতে পারবো না। কিন্তু মনের থেকে আমি চাই তুই নেতৃত্বে আয়।
হলের সম্মেলনের দিন পুরো হাউস আমার সমর্থনে খুব শক্ত ভূমিকা নিলো। অনেক বলা না বলা ঘটনা ঘটলো, এটাই রাজনীতি। আমাকে সভাপতি এবং বাবলুকে সাধারণ সম্পাদক করে বাহাদুর ভাই-খোকন ভাই কমিটি ঘোষণা করলো। বন্ধু বিপ্লব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হলো।
তারপরে খোকন ভাইয়ের সাথে অনেক স্মৃতি, যা বলে শেষ করা যাবে না। বিভিন্ন উৎসবে খোকন ভাই ফোনে ডেকে নিয়ে পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে বলতো-এটা তোর জন্য আমার দোয়া।
খোকন ভাই আপনি কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন, আপনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন, আপনি থাকবেন আমার মনে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় চিরদিন। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
হিমু, ২ অক্টোবর ২০১৬
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ
বিবার্তা/কাফী