তবুও থেমে নেই অদম্য মহিদুল

তবুও থেমে নেই অদম্য মহিদুল
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:২৬:০০
তবুও থেমে নেই অদম্য মহিদুল
এইচ আর তুহিন, যশোর
প্রিন্ট অ-অ+
ভ্যানচালক বাবার ক্যান্সারে ভুগে ভুগে মৃত্যু কিংবা অভাবের সংসার- কোনো কিছুই দমাতে পারেনি মেধাবী ছাত্র মহিদুলকে। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। 
 
এইচএসসির ভালের ফলাফল করে শিক্ষকদের আশীর্বাদ নিতে যাওয়ার সময় তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। ১০ দিন রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে দু’কেজি মিষ্টি কিনে তারপরই যান কলেজে।
 
মহিদুল যশোর সদরের চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ঝাউদিয়া কারিকরপাড়ার মৃত শহিদ হোসেনের ছেলে। তার মায়ের নাম রাজিয়া বেগম। মোটে দুই শতক জমিতে টিনের বেড়া আর টালির ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরে থাকেন মা ভাইদের নিয়ে।
 
মহিদুল ২০১৪ সালে যশোরের মুন্সী মেহেরউল্লাহ অ্যাকাডেমি থেকে এসএসসি (মানবিক) পাশ করেন জিপিএ ৪.২৫ পেয়ে। এরপর ২০১৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন, তার প্রাপ্ত জিপিএ-৫।
 
তিনি জানান, বাবা ভ্যান চালাতেন, ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন গত বছরের ১৭ মার্চ। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়ভার বেশ খানিকটা তার উপরে বর্তায়। এইচএসসির ফলাফল দিয়েছে ১৮ আগস্ট। পরীক্ষায় পাশ করা ছেলেমেয়েরা কলেজের অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেছে, মিষ্টি খাইয়েছে। অথচ, জিপিএ-৫ পাওয়া অল্প কয়েকজনের একজন মহিদুল মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে গেছেন ১২ দিন পর। 
 
কলেজ অধ্যক্ষ আবু মাসুদসহ অন্য শিক্ষকরা বেশ কৌতূহলী হলেন। জানতে চান- এত দেরি করে দেখা করতে এলে কেন মহিদুল? তার জবাব শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যশোরের কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের অধ্যক্ষসহ অন্য শিক্ষকরা। গর্বে তাদের বুক ভরে যায়। এই ছেলে শিক্ষকদের মিষ্টিমুখ করাতে মাথায় ইট আর সিমেন্টের বস্তা নিয়ে রাজমিস্ত্রির যোগালি হিসেবে কাজ করেছে। সেখান থেকে প্রাপ্ত টাকার অংশ দিয়ে মিষ্টি কিনে তবেই দেখা করতে এসেছে সে।
 
মহিদুল জানান, বাবা সবসময় ভ্যান চালাতে পারতেন না, অসুস্থ থাকতেন প্রায়ই। 
 
সেকারণে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালেই তাকে মাঝেমধ্যে রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করতে হতো। প্রথমদিকে ১৭০ টাকা পেতেন মজুরি। এরপর আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ ৩০০ টাকা পেয়েছেন।
 
তিনভাই এক বোনের মধ্যে তিনি মেঝো। বড়বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বড়ভাই বেশি একটা পড়ালেখা করতে পারেননি। একটি ফার্নিচারের দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ছোটভাই এখন ক্লাস এইটে পড়ে।
 
তিনি জানান, এসএসসি পাশ করার পর লেখাপড়া করার আগ্রহটা বেড়ে যায়। ইন্টারমিডিয়েট ভর্তির আগ পর্যন্ত তিনি সুবিধামত সময়ে কাজ করেছেন যোগালির। মাঝেমধ্যে কাজ থাকতো না। এরমধ্যে কিছু টাকা জমিয়ে তিনি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন কলেজে। কলেজে ভর্তির তিন-চার মাসের মধ্যে বাবা মারা যান।
 
কলেজে ভর্তির পর ছুটিরদিনে তিনি যোগালির কাজ করতেন; আর টিউশনি ছিল কয়েকটা। টিউশনি থেকে মাসে দু’হাজার করে টাকা আসতো। যা তার মায়ের হাতে তুলে দিতেন; সংসারের কাজে।
 
এসব বিষয় জানতে পেরে কলেজের অধ্যক্ষ, গাইড টিউটর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূরুল আলম, ইংরেজি শিক্ষক কামরুল হাসান বাপ্পীসহ অন্য শিক্ষকরা তাকে খুবই সহযোগিতা করেছেন। তার কাছ থেকে প্রাইভেটের কোনো ফি নিতেন না স্যাররা; এমনকি মাঝেমধ্যে নগদ টাকা দিয়েও সহায়তা করেছেন। 
 
বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করছেন। আশা আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি অথবা ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করা। এরপর হয় ব্যাংকার না হয় শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিতে চান। 
 
কলেজের অধ্যক্ষ আবু মাসুদ বলেন, ছেলেটা যেমন দরিদ্র, তারচেয়ে বেশি মেধাবী। এসএসসির তুলনায় এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছে। এর পেছনে তার একাগ্রতা, পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ আর পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রচেষ্টা ছিল। কলেজে ভর্তির পর থেকেই তার প্রতি আমাদের বিশেষ নজর ছিল। শিক্ষকরা তাদের সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন।
 
তিনি বলেন, সমাজের বিত্তবান মানুষদের কেউ যদি এগিয়ে আসেন তাহলে সংগ্রামী এই ছেলেটার জীবনচলার পথ কিছুটা সহজ হতো।
 
বিবার্তা/তুহিন/কাফী
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com