শৈশবে আমার হাতে গোনা যে ক’জন বন্ধু ছিল তাদের মধ্যে প্রথমেই ছিল শ্যামা প্রসাদের নাম। আমরা ডাকতাম ‘শ্যাম’ বলে। কুচকুচে কালো আর লিকলিকে গড়ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একইসঙ্গে লেখাপড়ার হাতেখড়ি।
লম্বালম্বি আমাদের গ্রাম। প্রায় দুই মাইল। একপ্রান্তে আমাদের বাড়ি আর অন্যপ্রান্তে তাদের। বিলের মধ্যে একটি বাড়িতেই ছিল ওই হিন্দু পরিবারের বাস। বর্ষায় যাতায়াতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হতো তাদের। হয়তো বা বংশ পরম্পরায় সয়ে নিয়েছিল তারা। খুব সুন্দর হাতের লেখা ছিল শ্যামের।
গ্রামীণ অর্থনীতির হিসাবে আমাদের পরিবারকে ধনাঢ্যই বলা হতো। শ্যামদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো না হলেও আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে তা কখনো প্রভাব ফেলেনি। আমাদের বাড়িতে শ্যামের ছিল অবাধ যাতায়াত। একসঙ্গে ভাতও খেতাম আমরা। আমিও দু’একবার খেয়েছি তাদের বাড়িতে। ধর্ম, বর্ণ যে বিভেদের কারণ, তা জানতে পারিনি কখনো।
প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে শ্যামসহ অন্য বন্ধুদের টানেই আমি বাড়ির পাশের হাইস্কুল বাদ দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম আড়াই মাইল দূরের স্কুলে। বাবাও এর বিরোধীতা করেননি। বরং সহায়ক হিসেবে কিনে দিয়েছিলেন একটি বাইসাইকেল। গ্রামের পরিবেশে একটা সাইকেল থাকা তখন ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।
তবে, অধিকাংশ দিন অর্ধেকটা পথ সাইকেল না চালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হেঁটেই বাড়ি ফিরতাম। গল্পটা এ’ পর্যন্ত থেমে গেলে হয়তো ভালোই হতো। কিন্তু, ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। হঠাৎ একদিন শুনলাম শ্যামরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে।
দু’টি পরিবার ছিল ওই বাড়িতে। দু’টি পরিবারই দেশান্তর। খবরটা শুনেই বুকের মধ্যে হু হু করে উঠলো। সাহস পেলাম না ফাঁকা বাড়িটি শেষবারের মতো দেখতে যাওয়ার। শ্যামও হয়তো এখন আমার মতো পরিণত। জানি না সে কেমন আছে। তবে, খুব জানতে ইচ্ছে হয় এতো কী কষ্ট ছিল তোদের বুকের মধ্যে লুকানো!
শ্যামদের বাড়িটি খুবই ফাঁকা জায়গায় থাকলেও সেখানে কখনো চুরি, ডাকাতি হয়েছে বলে শুনিনি। আর ধর্মের কারণে বিভেদ, তা চোখে পড়েনি কখনো। তাহলে কেন চলে গেলি শ্যাম!!
ব্যস্ত জীবনে, এখন প্রায়ই মনে পড়ে শৈশবের কথা। সব সময় আগলে রাখা আমার বাবাও চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দায়িত্বের অনেক বোঝা কাঁধে নিয়ে শৈশবের দিনগুলোই যে এখন সুখস্মৃতি! আর তাই বারবার মনে পড়ে মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে থাকা শৈশবের বন্ধুদের।
শ্যাম, ভালো থাকিস বন্ধু আমার। যদি মনে পড়ে জন্মভূমির কথা, শৈশবের বন্ধুদের কথা, তাহলে এসে দেখে যা- তোর জন্য এখনো রক্তক্ষরণ হয় অনেক হৃদয়ে।
শেখ জাহিদের ফেসবুক থেকে
বিবার্তা/কাফী