রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আসাদগেটে দেখি এক সিএনজি ড্রাইভারকে গণপিটুনি দিচ্ছে জনতা। এক রিকশাকে ধাক্কা মেরেছে সে। রিকশাযাত্রী পড়ে যায়। রিকশাচালক সিএনজির সামনে গিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করে। সিএনজি চালক তারপরও দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। পিটুনি দেওয়া জনতার অভিযোগ, আরেকটু হলে রিকশাওয়ালাকে মেরেই ফেলছিল সিএনজি ড্রাইভার।
গণপিটুনির কোনো নিয়ম নীতি নেই। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম উপড় নিচ চারদিকেই এর সমান দাপুটে বিচরণ। মার খেতে খেতে সিএনজি চালকের বেহাল দশা। বাইক পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম। জনতাকে উদ্দেশ করে ছোট ভাষণ দিলাম। বললাম, ‘ভাই সিএনজি চালক রিকশাওয়ালাকে মেরেই ফেলছিল। আপনারা তো এখন সিএনজিচালককে মেরেই ফেলবেন। তাহলে তো আপনারাও ফাঁসবেন।’
কেনো জানি জনতার মনে কথাটা ধরল। মাইর থামল। তবে মাইরের মাঝে পড়ে আমার চোখের পাশে কয়েকটা লেগেছে। গণপিটুনির ধর্ম এমনি। দিতে পারলেই হলো। কার গায়ে পড়ল এটা বড় কথা না।
দেখলাম, রিকশাওয়ালার পা কিছুটা ছিলে গেছে। তাকে পাঠালাম পাশের হাসপাতালে। সিএনজি চালককে বললাম, রিকশাওয়ালার চিকিৎসাবাবদ খরচ ও রিকশার ক্ষতিপূরণ দিতে। চিকিৎসা আর ক্ষতিপূরণবাবদ আসল তিন হাজার দুইশ টাকা। সিএনজি চালক কান্না শুরু করে দিলেন। তার মালিক ফোন ধরে না। পকেটে আছে আটশ টাকার মতো। এক ঘণ্টা পার। সিএনজি চালক আমাকে যেতে দেয় না। বললেন, ‘ভাই আপনি চলে গেলে মাইরা ফেলবে।’ তারে বললাম, ‘আপনার একটা মাইর আমার চোখে পড়ছে। আমি থাকলে তো আরও কয়েকটা পড়তে পারে।’ যাই হোক, মানিব্যাগটা বের করে দেখলাম, আছে ছয় শ টাকা। দিয়ে দিলাম। হলো ১৪শ। বাকি টাকা?
মারমুখী জনতার একজন বলল, ‘ঠিক আছে, আমি দুইশ টাকা দিচ্ছি।’ আরেক মারমুখী বলল, ‘আমি একশ টাকা দিলাম। হইছে কিনা দেখেন।’ এভাবে কয়েকজন মারমুখী জনতার সহযোগিতায় উঠে গেল দুই হাজার টাকা। ওইদিকে হাসপাতাল ওয়ালারা বলল, ‘আপনারা যখন সবাই এগিয়ে আসলেন। যান আমরা চিকিৎসাবাবদ আসা টাকার তিন ভাগের এক ভাগ নেব।’
ওইদিকে রিকশাওয়ালাও বলল, ‘যান ভাই আমি মাফ কইরা দিছি। আমার রিকশার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দরকার নাই। যে টাকা উঠছে ওই টাকা দিলেই চলবে।’ দেখলাম, রিকশাওয়ালাকে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন সিএনজিওয়ালা। মাফ চাইলেন। আর কখনও এভাবে গাড়ি চালাবেন না বলে ওয়াদা করলেন। একে অপরের মোবাইল নম্বর নিলেন। সিএনজিওয়ালা আমাকেও জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। বললেন, ‘ভাই, জীবনটা বাঁচাইলেন। সারাজীবন মনে রাখমু।’ বললাম, ‘আমার চোখ এখনও টনটন করতেছে। আমার চোখের জন্য দোয়া কইরেন।’ সিএনজিওয়ালা অনেকক্ষণ পর হাসলেন। বিদায় নিলেন।
বাসায় ফিরে ভাবছি, যে লোকগুলা সিএনজিওয়ালারে মেরেই ফেলতে চাইল, তারাই আবার তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করল.... বিষয়টা কি? বুঝলাম, গণপিটুনি জিনিসটা ছোঁয়াচে। শুরু করলেই ছড়িয়ে পড়ে । মানবিকতার বিষয়টাও ছোঁয়াচে। শুরু করে দিলেই ছড়িয়ে পড়বেই...
কাজী আনিসের ফেসবুক থেকে নেয়া