৭১’র বীরাঙ্গনা চাইন্দাউ মারমার কাঁধে এখন ভিক্ষার ঝুলি...। ১৯৭১ সালে ফুটন্ত গোলাপের ন্যায় অপরূপ সুশ্রী ষোড়শী এক নারী ছিলেন তিনি। অন্যান্যদের মতো স্বামী সংসার নিয়ে তারও ছিল সুখের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নিতে দেয়নি পাক-হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধকালীন মহালছড়ি বাজার থেকে পাক-হানাদার বাহিনী চাইন্দাউ মারমাকে জোর করে ধরে নিয়ে দীর্ঘদিন আটকে রেখে নির্যাতন করে।
উইমেন চ্যাপ্টারে খাগড়াছড়ি জেলার সংবাদকর্মী চিংমেপ্রু মারমা প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে মহালছড়ির এক চালের গুদামে পরে মানিকছড়ি, গুইমারা, রামগড়, মাটিরাঙ্গা, লোগাং, পুজগাং, পানছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করা হয়।
পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপণ যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেলে সে সুযোগে চাইন্দাউ মারমাও ফিরে আসে তার গ্রামে। প্রথমে আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ তাকে গ্রহণ করতে চায়নি। এক পর্যায়ে গ্রামে আশ্রয় পান তিনি। তার স্বামীও আর সংসার করেননি তার সাথে।
বাংলাদেশের বিজয়ে সারাদেশের ন্যায় মহালছড়ির সবার মুখে হাসি ফুটলেও চাইন্দাউ মারমার জীবনটা অন্ধকারেই থেকে যায়। সবকিছু হারিয়ে লোক-সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়ে। চেহারায় সুন্দরী হলেও সমাজের চোখে হয়ে যায় সে এক ধর্ষিতা। ভালো পাত্র আর তার জীবনে কেইবা আসবে। তারপরও নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখে জীবনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বয়স বেশি হলেও অনেক আশা নিয়ে জনৈক এক বৃদ্ধ লোককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে সংসার করতে চান। কিন্তু কয়েকবছর যেতে না যেতেই সেই স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা।
২০১৪ সালে সিএইচটি নিউজ ডট কমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তখন থেকেই ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে করে সারাদিন ঘুরে ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়েই চলে তার জীবন আহরণ। বৃদ্ধ বয়সে এখন ভাইয়ের একটি ভাঙা ঘরে তার আশ্রয়। সরকারি বা বে-সরকারি কোনো সংস্থা তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে অথচ আদিবাসীদের মতো নির্যাতিত নারীদের প্রতি কোনো খবর রাখে না, দুঃখে ভরা স্মৃতিবিজরিত এসব কথাগুলো নিজস্ব ভাষায় বলেছিলেন ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ চাইন্দাউ মারমা।
৭১’র এই বীরাঙ্গনা খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার থলিপাড়া নামক গ্রামের বাসিন্দা। সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে অবশেষে ভাগ্যে জুটলো ভিক্ষার ঝুলি। এই ভিক্ষার ঝুলিই এখন তার একমাত্র সম্বল।
মহালছড়ি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার চাইলাপ্রু মারমার তথ্য অনুযায়ী, চাইন্দাউ মারমা ৭১’র একজন বীরঙ্গনা। চাইন্দাউ মারমা ছাড়াও মহালছড়িতে আরো একজন বীরাঙ্গনা আছে, তার নাম হ্লাম্রাসং মারমা। এরা দু’জনেই সুন্দরী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানিরা গ্রামের সুন্দরী দেখে তাদের দুজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন যাবত আটকে রেখে নির্যাতন করে। তখনকার সময়ে তাদের দুজনের বিসর্জনে মহালছড়িবাসী অনেকটা শান্তিতে ছিল। স্বাধীনতা অর্জনে তাদের অবদানও অনস্বীকার্য।
তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তাদের দুরাবস্থা দেখে বিভিন্ন দফতরে তদবির করেও সরকারিভাবে তাদের কোনো সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদেরও সরকারি ভাতা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
মাসুদ আরিয়ানের ফেসবুক থেকে
বিবার্তা/নিশি