মিলন ভাইকে নিয়ে কিছু লেখা দুটো কারণে খুব কঠিন।
প্রথমত হুমায়ুন আহমেদ।
তিনি তাঁর ভীষণ প্রিয় ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে এত এত লিখেছেন যে অন্যেরা লিখবে কি? ধারণা করি, হুমায়ুন আহমেদ কোনো একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে। তিনি সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় ‘বলপয়েন্ট’নামে একটি প্রায়-আত্মজৈবনিক কলাম লিখতেন। আমি তখন ওই পত্রিকায় কাজ করি। সেসময় দেখেছি বলপয়েন্টের প্রায় সব লেখাতেই কোনো না কোনোভাবে ইমদাদুল হক মিলন থাকতেন।
দ্বিতীয়ত, ইমদাদুল হক মিলন আমাদের সাহিত্যজগতের এত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্ব, আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষ তাকে নিয়ে কি লিখব? পাছে কোনো ভুল হয়ে যায়।
তবুও সাহস করছি। বিশেষ দিনের বিশেষ লেখার ব্যাপারে সাহস করা যায়।
মিলন ভাইকে প্রথম দেখি খুব সম্ভবত ২০০০ সাল কিংবা তার কিছু আগে-পরে। সামনাসামনি সেদিন তাঁর দেখা পেয়েছিলাম কিনা মনে নেই। তবে তাঁর বসবার ঘর দেখেছিলাম। সেটা দেখেই একটা বাকুম বাকুম ভাব তৈরি হয়েছিল মনে।
তিনি তখন ‘কিশোর তারকালোক’নামে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। সেখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাস ‘ফিরে এলো রমাকান্ত কামার’।‘রমাকান্ত কামার’নামটা এমন, যার বর্ণগুলো উল্টো দিক দিয়ে সাজালেও একই জিনিস দাঁড়ায়। দারুণ ব্যাপার! আমরা গোগ্রাসে রমাকান্ত কামারের ফিরে আসার গল্প পড়ছি।
তখন কৈশোর পেরিয়ে তরুণ হবার লাইনে দাঁড়িয়েছি মাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি কিংবা হতে যাচ্ছি। তখন পকেটভর্তি লেখা আর বুকভর্তি সাহস নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে যাওয়া ছিল নেশার মতো। প্রতিদিন কোনো না কোনো অফিসে যেতাম।
একদিন দুটো লেখা নিয়ে চলে গেলাম গ্রীণরোডের তারকালোক কমপ্লেক্সে। ভরসা, কিশোর তারকালোকে এর আগেই পাঁচ-ছটি লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আর ভরসা ছিল ওবায়দুল গণি চন্দন ভাই। তিনিও তখন কিশোর তারকালোকে কাজ করতেন।
মাঝে পনের বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মিলন ভাই এখনও সম্পাদক। কালের কন্ঠ নামের বিশাল আঙ্গিকের একটি দৈনিক পত্রিকার। একই সঙ্গে বড় লেখক এবং বড় সম্পাদক হওয়া কঠিন না, প্রায় অসম্ভব। তিনি সেটাও করে দেখিয়েছেন।
আসলে মিলন ভাইয়ের পুরো জীবনটাই এরকম নানান বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাই তাঁর নামের পাশে বিশেষণ বসাতে গেলে সেটা বেশ লম্বা হয়ে যাবে। তবে ‘কথাসাহিত্যিক’এই পরিচয়ের বাইরে ইমদাদুল হক মিলনের আর কোনো পরিচয়ের দরকার পড়ে না।
সমানভাবে এটাও সত্য, ইমদাদুল হক মিলন এই নামটাই আসলে তাঁর সব পরিচয় ধারণ করে। গল্প-উপন্যাসে তিনি যেমন নিজের জাত চিনিয়েছেন তেমনি নাট্যকার হিসেবেও পেয়েছেন সমান জনপ্রিয়তা।
বিটিভির সেই যুগে জনপ্রিয় নাটকের কিছু সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বাংলা নাটকের জনপ্রিয় সংলাপের যে তালিকা তাতে সবচেয়ে বেশি সংলাপ ইমদাদুল হক মিলনের নাটকের। ‘বারো রকম মানুষ’নাটকে তারিক আনাম খানের সংলাপ ‘থামলে ভালো লাগে’, কিংবা ‘রূপনগর’নাটকে খালেদ খানের ‘ছি! ছি! ছি! তুমি এত খারাপ অথবা রফিকুল্লাহ সেলিমের কন্ঠে ‘বিক্রমপুইরা পোলা আশি টাকা তোলা’এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ আছে।
লেখকদের সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে, তারা অগোছালো হন। মিলন ভাইকে যারা দেখেছেন, এ কথায় তাঁরা হাসবেন। তাঁর মতো কেতাদুরস্ত এবং পরিপাটি মানুষ খুব কম দেখা যায়। এই ষাটে এসেও তিনি আগের মতোই ফিটফাট। ষাট বছর বয়সকে মজা করে বলা হয় ‘বালাই ষাট’। মিলন ভাইয়ের বেলায় সেটা উল্টো। ‘পালাই ষাট’।
ভাগ্যিস, নায়ক-নায়িকাদের মতো লেখকদের বয়স লুকানোর রেওয়াজ নেই। তাহলে তো মিলন ভাই পঁয়তাল্লিশেই আটকে থাকতেন। তিনি বলতেন, পঁয়তাল্লিশ। লোকজন বলত, আরও কম। হা হা হা।
লেখকদের বয়স নাকি পঞ্চাশে শুরু হয়। সেই হিসেবে মিলন ভাইয়ের বয়স তো মোটে দশ। তবে ষাট বা দশ যাই হোক, দুটোই সংখ্যা মাত্র।
আপনার মনের বয়স কতো সে তো আমাদের জানাই আছে।
শুভ জন্মদিন মিলন ভাই।
লেখক : সাহিত্যিক ও নাট্যকার।
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন