সম্পর্ক

সম্পর্ক
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:১৬:০৯
সম্পর্ক
শরীফ রুহুল আমীন
প্রিন্ট অ-অ+
আরিফের কিছুদিন থেকে মন ভাল নেই। স্ত্রীর সাথে দীর্ঘদিন থেকে একটা খ্যাটম্যাট লেগেই আছে। আরিফ ও তার স্ত্রী রিজিয়া দুজনেই চাকরিজীবি। আরিফ একটি সরকারি সংস্থায় কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আজ প্রায় ষোল বছর ধরে। আর তার স্ত্রী রিজিয়া বারো বছর ধরে চাকরি করছে একটি বেসরকারি ব্যাংকে। বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিতে পরিশ্রম আছে কিন্তু প্রাপ্তিও ভাল। মোটা অংকের মাইনে পায়। তাদের একটি কন্যা সন্তান। ঢাকার দামী ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। আরিফের অনেক শখ ছিল তার একটি পুত্র হবে। তবুও কন্যা সন্তান লাভের পর আরিফ ভীষণ খুশি হয়েছিল। প্রথম সন্তানের মুখ দেখে স্বামী স্ত্রী দুজনেই আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। আরিফের স্ত্রীর বড় বোন বলেছিল, আরিফ তুমি বড় ভাগ্যবান। যার প্রথম সন্তান কন্যা, সে খুব ভাগ্যবান। কথাটি আরিফের খুব মনে ধরেছিল।
 
রিজিয়া জানত আরিফের পুত্র সন্তানের শখের কথা। আরিফ পুত্রকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাবে, একসাথে সুইমিং পুলে গিয়ে সাঁতার কাটবে ইত্যাদি শখের কথা সন্তান জন্মের আগেই আরিফ স্ত্রীর সাথে শেয়ার করত। তাই রিজিয়া কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ার কয়েকদিনের মাথায় জিজ্ঞেস করে, আরিফ তুমি কি খুশি হওনি? - এ তুমি কী বলছ রিজিয়া?  এত সুন্দর ফুটফুটে একটি কন্যা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন আর খুশি হব না? আরিফ উত্তর দেয়। রিজিয়াও বুঝতে পারে, হ্যাঁ আরিফ কন্যাকে আদর করে, গালে গাল লাগায়, দোলনা থেকে তুলে জোর করে কোলে নেয়। এসব দেখে রিজিয়া মাথা থেকে পুত্রসন্তান লাভের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। কিন্তু একবছর যেতেই আরিফ দ্বিতীয় সন্তান নেয়ার জন্য রিজিয়াকে অনুরোধ করে। রিজিয়া বলে, আরিফ তুমি কী বলো তো? তোমার সন্তানের বয়স একবছর পার হতে না হতেই তুমি দ্বিতীয় সন্তান নেয়ার কথা বলছ! কোন গ্যারান্টি আছে দ্বিতীয় সন্তানটি ছেলে হবে? – এখন বললাম বলেই যে এখনি হয়ে গেল তা তো নয় রিজিয়া। তুমি এভাবে রিএ্যাক্ট করছ কেন? আরিফের উত্তর। - না আরিফ, তুমি আরো দুতিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তানের কথা মুখে আনবে না প্লীজ- রিজিয়া চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে বলে। - ঠিক আছে, বলব না। 
 
এভাবে আরিফ-রিজিয়ার সংসার চলতে থাকে। ইতোমধ্যে রিজিয়ার ছ’মাসের মাতৃত্ব ছুটি শেষ হয়ে গেছে। সে পুনরায় অফিসে যোগদান করেছে। মেয়েকে প্রতিপালনে সুবিধের জন্য আরিফ তার মাকে নিয়ে এসেছে ময়মনসিংহ থেকে। সাথে এনেছে ছোট একটি কাজের মেয়ে। রিজিয়া সকালে বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে, নাশতা সেরে, স্বামীকে নাশতা দিয়ে অফিসে চলে যায়। তার শ্বাশুড়ী দুপুরে মেয়েকে দুপুরে গোসল করিয়ে দিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক পুষ্টিকর নরম খাবার শিশুর জন্য তৈরি করে খাইয়ে দেয় । বিভিন্ন সময় শিশুর পায়খানা পেশাব পরিষ্কার করে কাজের মেয়েটির সহযোগিতায়। মাসখানেক না যেতেই শ্বাশুড়ী হাঁপিয়ে ওঠেন। তিনি ময়মনসিংহ চলে যেতে চান। ‘ না, আম্মা আপনি যেতে পারবেন না। আমি খুব অসুবিধায় পড়ব, চাকরি করতে পারব না। কথাটা আরিফের সামনেই হয়। আরিফ এমনি এক পরিস্থিতিতে রিজিয়াকে বলে, রিজিয়া তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। আমার একার ইনকামে যা হয়, সংসার চালিয়ে নেয়া যাবে। দেশে আব্বার শরীরটা ঠিক ভাল নয়। মার যাওয়াই দরকার। – কী বলছ আরিফ, আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলছো? তোমার মুরদ আছে একলার চাকরিতে সংসার চালানো ? আর চাকরি ছাড়তে হয় তুমি ছাড়ো। আমাকে বলছ কেন? – আরিফ থ হয়ে যায়। সে কথা বাড়াতে চায় না তার মায়ের সামনে। কিন্তু রিজিয়ার এই কথা তার মর্মের ভেতর একধরনের শেলের ন্যায় বিঁধে গেল। এত বড় কথা, রিজিয়া বলে কিনা আমাকে চাকরি ছাড়তে! সে স্ত্রী হয়ে চাকরি করবে আর আমি স্বামী হয়ে ঘরে বসে রান্নাবান্না করব?-আরিফের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল। 
 
সেই থেকে আরিফ-রিজিয়ার দাম্পত্য কলহের বীজ সমূলে প্রথিত হল। তারপর দীর্ঘ বারো বছরে বিভিন্ন রক্মের মতদ্বৈততা হয়েছে। কিন্তু সব চাইতে যে বিষয়টি আরিফ মেনে নিতে পারেনি তা হলো দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণে রিজিয়ার বারবার অনীহা। এই গত মাসে তাদের সন্তান দশে পা দিয়েছে। এখন আর দ্বিতীয় সন্তানের কথা আরিফ ভাবে না। কয়েকবছর পূর্বেই সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। এখন তাদের একমাত্র কন্যা আয়েশাকে কিভাবে ও-লেভেল এ-লেভেল করিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতা করা যাবে সেটাই আরিফ-রিজিয়া দম্পতির ধ্যান-জ্ঞান।
 
এর মধ্যে হঠাৎ আরিফের বদলী্র আদেশ হয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান। স্ত্রী ও সন্তানের দিকে চেয়ে বদলী ঠেকানোর চেষ্টা কয়েকবার করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। অফিস থেকে বলে দিয়েছে- ‘আরিফ সাহেব, আপনি সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন আর আজ আপনি নির্বাহী প্রকৌশলী। কাজেই অন্তত এক-দুবছরের জন্য হলেও যে কোন ফিল্ড অফিসে আপনাকে যেতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে আপনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি বিবেচনা থেকে বাদ পড়ে যাবেন। অর্থাৎ অবস্থা এমন যে তাকে ফিল্ড অফিসে যেতেই হবে আর ঢাকার আশে পাশে কোথাও পোস্ট খালি নেই। তাই সে তার স্ত্রীকে বিষয়টি জানালে, তার স্ত্রীও তাকে বান্দরবান যাবার জন্য বলল। এভাবে আরিফ পার্বত্য বান্দরবানে পাড়ি দিল। প্রতিমাসে এক দু’বার ঢাকায় আসে। কিন্তু নিয়মিত আসা যায় না। বিদ্যুৎ বিভাগের জরুরী সার্ভিস। এখানে শুক্রবার বা শনিবার ছুটি কাটাতে পারবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই।
 
বান্দরবানে ইতিপূর্বে সে এসে একদু’দিনে থেকেছে, তবে সে অনেক আগে। বিয়ের পূর্বে যখন সে চাকরিতে যোগদান করে তখন ফাউণ্ডেশন ট্রেনিং এর জন্য কাপ্তাই প্রকৌশল একাডেমিতে থেকেছিল দুমাস; এ ট্রেনিং এর অংশ হিসেবে সে বান্দরবান শিক্ষা সফরে এসেছিল।
 
চাকরিতে বদলী হয়ে এসে কিছুদিন তার বেশ খারাপ লাগছিল পরিবার থেকে দূরে থাকার জন্য। ধীরে ধীরে কলিগদের সাথে ও অন্যান্য অফিসের অফিসারদের সাথে পরিচয় হবার পর সেটা কমে এসেছে। তাছাড়া বান্দরবান ট্যুরিস্ট শহর হওয়াতে সারা দেশের মানুষই প্রায়ই বেড়াতে আসে। ফলে ছোট শহর হলেও বেশ জমজমাট। গত রোববার সে তার চাকমা কলিগ মণীষের সাথে নীলাচলে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে হঠাৎ মণীষের বান্ধবী মণিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মণীষ। মণিকা চাকমা সাধারণ পাহাড়ীদের মত লাজুক নয়, মিশুক। সে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট। বাড়ি খাগড়াছড়ি। চট্টগ্রাম কলেজে বাঙ্গালি রুমমেটের সাথে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছে। বাংলা গানও গায় খুব ভাল। বাঙ্গালি মনও সে বুঝতে পারে। প্রথম পরিচয়েই মণিকাকে বেশ লাগে আরিফের কাছে। মণিকা পাহাড়ী পোশাকেই এসেছে। সুন্দরী, নাক চ্যাপ্টা নয় অন্যদের মত। মোটা ঘন কালো চুলের লম্বা বেণী পিঠের ওপর ঝুলছে কালো দাড়াশ সাপের মত। সে বান্দরবান শহরেই একটি স্কুলে পড়ায়। প্রথম পরিচয়ে আরিফ আর মণিকা তাদের সেল নাম্বার বিনিময় করে নেয়। তারপর অনেকদিন কথাবার্তা নেই।
 
আরিফ বান্দরবান থেকে ঢাকা গেছে। বৃহষ্পতিবার বিকেলে সে অফিসের গাড়িতে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে গিয়ে রাত এগারোটা নাগাদ বাসায় পৌঁছেছে। মেয়ে তখন ঘুমিয়ে গেছে। আরিফের স্ত্রী দরজা খুলে দিয়েছে। রাতের ডিনার সেরে রিজিয়ার পাশে শুয়েছে। রিজিয়ার গায়ের ওপর হাত দিতেই সে ঝট করে হাত দূরে ঠেলে দেয়। বলে, প্লীজ ডিস্টার্ব করো না। আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আরিফের মন খুব খারাপ হয়। এতদিন পর এল, আর রিজিয়ার এই ব্যবহার। শুক্রবার রাতেও একই অবস্থা। শনিবার দুপুরের লাঞ্চের পর আরিফ বান্দরবানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ে। বান্দরবানে পরের সপ্তাহটি অফিসের ব্যস্ততায় কেটে যায়। কিছুদিন পর সে হঠাৎ একদিন ফোন পায় অফিসে কাজ করতে করতে। ফোনে লেখা উঠেছে মণিকা কলিং। ফোন ধরতেই অপর পাশ থেকে ভেসে কথা ভেসে এল, - কেমন আছেন আরিফ দাদা ? আপনাকে খুঁজেছিলাম গত সপ্তাহে। মণীষদা বলল, ঢাকায় গেছেন। কেমন কাটলো? – হ্যাঁ কেটেছে ভাল। ধন্যবাদ। - ভাবী খুব আদর করলো বুঝি। সব খবর ভাল? – হ্যাঁ ভাল মোটামুটি। -কেন, মোটামুটি কেন? আজ ফ্রি আছেন পাঁচটার পর ? থাকলে চলুন আজ নীলাচলে। -ওকে। মণীষকে বলে দেখি ও ফ্রি আছে নাকি। -মণীষ দা না গেলেও অসুবিধা কী? ওখানে কত লোক পাবেন। -তা ঠিক, ওকে। দেখা হবে তাহলে, আরিফের উত্তর।
 
মণীষ সেদিন ব্যস্ত ছিল। কাজেই আরিফ একাই যায়। গিয়ে দেখে নীলাচলের একপাশে মণিকা তার জন্য অপেক্ষা করছে। মণিকার সাথে মৃদু শীতল বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে বেশ একটা নির্জন স্থানে গিয়ে তারা বসে পড়ল। মণিকা জেনে নেয় আরিফের সংসারের নানা খবর। আরিফও জানতে পারে মণিকার একটি বিয়ে হয়েছিল একটি পাহাড়ী ছেলের সাথে যে স্থানীয় কৃষি বিভাগে চাকরি করে। কিন্তু তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বছরখানেক আগে। পাশাপাশি বসে মণিকাকে বেশ ভাল লেগে যায় আরিফের। তার মনে পড়ে যায় ওর প্রতি রিজিয়ার দীর্ঘদিনের দাম্পত্য কলহ আর সাম্প্রতিক অবহেলা। সে ভাবে, আর কত ধৈর্য্য ধরবে সে। রিজিয়া গত একযুগ ধরে বিভিন্ন সময় অবহেলা করেছে তাকে। এসব কথা মনে হতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। মণিকা বলে, অত কী ভাবছেন?  যেখানেই থাকেন সবসময় হাসিখুশি থাকতে পারেন না?  আরিফ বলে, ‘বলেছিলেন আপনি চট্টগ্রাম কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান করতেন। একটা গান গাইবেন আমার জন্য’? মণিকা বুঝে নেয় আরিফের উড়ুউড়ু মনের অবস্থা। সে গায়, এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় একী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু----। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে কীভাবে আরিফ বুঝতে পারে না। গান শেষ করে মণিকা কখন তার বুকের ভেতর মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরেছে সে যেন বুঝতেই পারেনি। এক অপূর্ব ভাললাগা আরিফকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
 
বিবার্তা/মৌসুমী
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com