জার্মানির বন নগরীর ডুইসডর্ফ এলাকায় জার্মান-বাংলাদেশ সমিতির ‘হাউজ অফ ইন্টেগ্রেশন’ ভবনে সোমবার ঠিক বাংলাদেশের মতই ঈদের নামাজের আনন্দ-উপভোগ এবং ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির ছোঁয়া ও আমেজ উপভোগ করলেন জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
সকাল আটটায় অনুষ্ঠিত ঈদ-উল-আজহার জামাতে বন, কোলন, জিগবুর্গ, মেকেনহাইম, অয়েশকির্শেনসহ এর আশেপাশের এলাকা থেকে নতুন পোশাক পরে আতর-সুগন্ধি মেখে হাজির হন শতাধিক বাংলাদেশি ও অন্যান্য দেশের প্রবাসী নারীপুরুষ।
ঈদের নামাজ পড়ান সোমালীয় বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত জার্মান মাওলানা শাইখ হোসাইন। আরবি ভাষায় দেয়া খুতবার জার্মান অনুবাদ করেন হোসাইন আব্দুল হাই। ঈদের নামাজের পরে ধর্মীয় আলোচনায় খতিব হোসাইন ঈদের নামাজ এবং ঈদের উৎসবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য পুরস্কার হিসেবে এর নানা পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং তারই রাহে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে পালিত হয়ে আসছে ঈদুল আজহা। হযরত ইবরাহিম (আ.) এর আত্মত্যাগ ও অনুপম আদর্শের প্রতীকী নিদর্শন হিসেবে কোরবানি প্রচলিত হয়েছে।
মাওলানা শাইখ হোসাইন বলেন, পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শন করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করাটাই উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য যথাযথভাবে অর্জিত হলে কোরবানি করা সার্থক হয়। এ উৎসবে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য যেমন রয়েছে, তেমনি পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক নানা কল্যাণকর দিকও রয়েছে। সৌভ্রাতৃত্ব, ঐক্য সংহতি, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা সহানুভূতি প্রকাশের এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয় এই ঈদ। ঈদুল আযহার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যেক মুসলমানকে একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি, শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য আহ্বান জানান তিনি। ঈদের জামাত শেষে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করে এবং বিশেষভাবে মুসলমান অভিবাসীদের উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করে দোয়া করা হয়।
ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষ্যে দিনের শেষে ‘হাউজ অফ ইন্টেগ্রেশন’এ আয়োজন করা হয় সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে আসা রাজনৈতিক শরণার্থীদের জন্য এক প্রীতিভোজের। ঈদ উৎসবে বাংলাদেশি রাজনৈতিক শরণার্থীদের সাথে অংশ নেন হাউজ অফ ইন্টেগ্রেশনের সদস্য ও আমন্ত্রিত জার্মান অতিথিবৃন্দ।
গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকারে ‘হাউজ অফ ইন্টেগ্রেশন’এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি যুবরাজ তালুকদার জানান, ২০১২ সালে বন নগরীর ডুইসডর্ফ এলাকায় এই শিক্ষাকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে সেখানে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা শুরু করেন।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসী ভাইবোনদের জন্য এবং নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশি ও মুসলিম শিক্ষা, সংস্কৃতি পৌঁছে দেয়া এবং মূলধারার জার্মান সমাজের সাথে প্রবাসী ভাইবোনদের একটি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে এই শিক্ষা কেন্দ্র ও নামাজঘর।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগেও এই এলাকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে দেখেছি তাদের থাকা ও খাওয়ার করুণ অবস্থা। বাংলাদেশি রাজনৈতিক শরণার্থীরা জার্মানিতে আসার পর জার্মান খাবার খেতে পারেন না এবং পরিবার ও স্বজনদের ছেড়ে নিদারুণ মানসিক চাপে থাকেন। তাদের জন্য জার্মান সমাজে চলাফেরা করাও কঠিন সমস্যা হয়ে পড়ে, কারণ এখানে তাদের জার্মান ভাষা শেখার জন্য সরকার কোন ব্যবস্থাও করে না এবং কোন অর্থও দেয় না। তাই এখানে আমরা তাদেরকে নিয়ে আজ বাংলাদেশী আমেজে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। তাদের জন্য জার্মান ভাষা শেখানোসহ জার্মান সমাজের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য এই শিক্ষাকেন্দ্রে আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে’।
জার্মান প্রবাসী বিশিষ্ট বাংলাদেশী সমাজকর্মী নুরুল ইসলাম জানান, বন নগরীতে তুর্কি ও আরবের মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি মসজিদ থাকলেও মাতৃভাষায় খুৎবা ও দোয়া করতে পারা এবং দেশি ভাইবোনদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করতে পারবেন সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দূরদূরান্ত থেকে এখানে ঈদের নামাজ পড়তে ছুটে আসেন বাংলাদেশী প্রবাসী ভাই ও বোনেরা।
ঈদের জামাতে উপস্থিত হাউজ অফ ইন্টেগ্রেশন এর অন্যতম সংগঠক মিজ তামান্না তালুকদার বলেন, বাংলা ভাষায় ইমাম সাহেবের বক্তৃতা শোনা এবং বিশেষ করে নারী মুসল্লীদের জন্যও আলাদা নামাজের ব্যবস্থা করার কারনেই এখানে ঈদের নামাজ পড়ে খুবই ভালো লেগেছে।
বিবার্তা/হোসাইন/জিয়া