বাংলাদেশের প্রামাণ্যচলচ্চিত্র ‘ঝলমলিয়া’ (The Sacred Water) নিউইয়র্ক স্টেটের রাজধানী আলবেনী শহরের ক্যাপিটাল সিনেমা কালচারাল এক্সচেঞ্জ (CCCE 2016) এর সিনেমা ল্যাব ও প্রদর্শনীতে সমাপনী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টায় স্থানীয় আর্ট থিয়েটার লিন্ডায় হবে বাংলাদেশের প্রামাণ্যচলচ্চিত্র ঝলমলিয়ার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। এছাড়া আগামী ১৫ অক্টোবর চেক প্রজাতন্ত্রের বার্নো শহরে ছবিটির ইয়োরোপিয়ান প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হবে পরিবেশ বিষয়ে ইউরোপের প্রাচীনতম চলচ্চিত্র উৎসব ৪২ তম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল ইকোফিল্ম'১৬ এর প্রতিযোগিতা বিভাগে।
ঝলমলিয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জল, কাদা, জীবনের একটি ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের চলচ্চিত্র। ঘূর্ণিঝড় আইলা পরবর্তী ছয় বছর ধরে এই চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে মোংলা বন্দরের অনতি দূরে দক্ষিনাঞ্চলের একটি গ্রমে। বাংলাদেশের উপকূলীয় গ্রাম, গ্রামীণ জীবন এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবার চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবিতে। এক ঘূর্ণিঝড় হতে পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা পর্যন্ত চলচ্চিত্রের চিত্রধারণ চলেছে অবিরত।
ক্যাপিটাল সিনেমা সাংস্কৃতিক বিনিময় (CCCE) যুক্তরাষ্ট্রের আলবেনি শহরের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দ্বারা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য পরিকল্পিত এবং পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। সিসিসিই, আলবেনি নেদারল্যান্ডস এর রোটারডাম ফিল্ম ফেস্টিভাল এর অনুকরণে আলবেনির চলচ্চিত্র কর্মীদের একটি উদযোগ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। এই বছরের চলচ্চিত্র ল্যাবের অংশ নেয়ার জন্য জমা পড়া বিশ্বের নানা প্রান্তের চলচ্চিত্র ভাবনা হতে নির্বাচন করা হয়েছে দশটি চলচ্চিত্র প্রকল্প।
বাংলাদেশি প্রমাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল পরিচালিত ঝলমলিয়া এই বছরের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ল্যাব এবং স্ক্রিনিং এর অংশগ্রহণকারী হিসেবে শুধু নির্বাচিতই হয়নি, ছবিটি এ উৎসব আয়োজনের সমাপনী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শনের মর্যাদাও লাভ করছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশিমে উপকূলীয় অঞ্চলের এক গ্রামে একটি দীঘি আছে, নাম ঝলমলিয়া। সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় সমগ্র অঞ্চল জুড়ে সুপেয় পানির অভাব। দীঘিটি হয়ে আছে সেই অঞ্চলের মানুষের পানেয় জলের এক মাত্র উৎস। ২০০৯ সালে সাইক্লোন আইলায় সমগ্র অঞ্চল প্লাবিত হলেও দীঘিটি রক্ষা পায়। এই দীঘিকে ঘিরেই এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, লৌকিক-অলৌকিক গল্প আর কল্প কথা।
এক দুপুরে বালিকা সুমাইয়া বসে ছিল দীঘির পাড়ে। দশ বছরের সুমাইয়ার স্কুলে যায় না। মাঠে গরু ছাগল চরায়, ঘরে বসে বিভোর হয়ে দেখে হিন্দি সিরিয়াল। সুমাইয়ার বাবা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। সুমাইয়ার মা ওর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্য্যন্ত সুমাইয়ার মায়ের দম ফেলার সময় হয় না।
ঘরদোর সামলে ছুটতে হয় তাকে মাঠে ঘাটে সবখানে। মাঝে মাঝে নদীর ভাঙ্গা পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে, বাতাসে ওড়ে তার শাড়ির আঁচল। সন্ধ্যায় ঝলমলিয়ার ঘাটে জল আনতে যেতে যেতে অপেক্ষায় থাকে, কথা বলে কারো সাথে। সমস্ত দিনের হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পরে এই একটুকু তার মনের শান্তি।
প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে মানুষ টিকে থাকে, মনের সাথে যুদ্ধ করে মানুষ বাঁচতে পারে কি? ঝলমলিয়ার জলে টলমল করে মানুষের মুখচ্ছবি। দীঘির মিষ্টি জলে কখনো ঝড়ে পড়ে ক'ফোঁটা চোখের নোনা জল ক্যামেরার লেন্স তা ঠিক করে ধরতে পরে না। মানুষের অন্তরে অচিন যে পাখির বাস সে কেবল খাঁচা ছেড়ে উড়ে যেতে চায় বারে বারে। মুক্তি কি শেষমেষ মিলে কারো!
দিন যায়, বদলায় প্রকৃতি, পরিবেশ। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবনে তার প্রভাব পড়ে। প্রকৃতির ইচ্ছায় মানুষের ঘর ভাঙ্গে, মানুষ ভিটে ছাড়া হয়। নিজের ইচ্ছায়ও মানুষ ঘর ভাঙ্গে ঘর ছাড়া হয়। মানুষ বদলালে কতটুকু বদলায়? জীবন ভাসতে ভাসতে কখনো কী কোন পথ খুঁজে পায়?
পরিচালকের জীবনী: ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল কানাডার মন্ট্রিল একজন সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মন্ট্রিয়েল থেকে সিনেমা অধ্যয়ন ও টেলিভিশন উৎপাদনে ডিপ্লোমা প্রাপ্তির পর তিনি অনুষ্ঠান নির্মাতা ও সম্পাদক হিসেবে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ শুরু করেন। লেখালিখি আর সাংবাদিকতার পাশাপাশি কানাডা এবং বিদেশে বিভিন্ন চ্যানেলের জন্য নির্মাণ করেছেন স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, টিভি ম্যাগাজিন এবং প্রামান্যচিত্র।
বিবার্তা/সদেরা/জিয়া