কাশ্মিরের মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব ভারতীয় বুদ্ধিজীবী খুররম পারভেজকে বুধবার দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার তাকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয় দেশটির একটি আদালত। আদালতের নির্দেশের পর খুররম পারভেজকে পুনরায় গ্রেফতারের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অভিযোগ গঠন কিংবা বিচারের উদ্দেশ্য ছাড়া মুক্তি পাওয়ার পর একজন ব্যক্তিকে এভাবে আটকের নিন্দা জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক আকতার প্যাটেল। তিনি বলেন, আইনের এ ধরনের বিধিবহির্ভূত ব্যবহারের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জম্মু ও কাশ্মিরের পুলিশি যে কোনও মূল্যে খুররম পারভেজকে কারাগারে রাখতে চায়।
এর আগে খুররম পারভেজকে প্রথম দফায় গ্রেফতারের পর তার মুক্তির দাবি জানান সুবিখ্যাত মাকির্ন ভাষাতাত্ত্বিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক নোম চমস্কি এবং বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি অর্জন করা ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়সহ ৫২ জন বুদ্ধিজীবী। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল.ইন-এর এক খবরে তাদের এ সংক্রান্ত একটি খোলা চিঠি লেখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। হুবহু ওই খেলা চিঠি প্রকাশও করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইরত সেইসব তরুণদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবেই দেখে ভারত রাষ্ট্র। কাশ্মিরে পাকিস্তানপন্থীদের তৎপরতা থাকলেও সেখানে সরাসরি কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইকারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে ভারতের দাবি, কাশ্মিরে যারা লড়াই করছেন তারা আসলে জঙ্গি, বিচ্ছিন্নতাবাদী। কাশ্মির প্রশ্নে সমগ্র ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গিতেই সেখানকার সমস্যাকে ‘বিচ্ছিন্নতা আর জঙ্গিবাদের’ সমস্যা আকারে দেখা হয়ে থাকে। বিপরীতে কাশ্মিরিদের কাছে সেখানকার লড়াই আদতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই। কাশ্মিরের স্বাধীনতার প্রশ্নে সরব খোদ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরাও। ভূবনখ্যাত বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতি রায় স্পষ্ট করে বলেন, সেখানে আসলে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসন চলছে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মিরবাসীকে। কাশ্মির সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা।
উল্লেখ্য, খুররাম পারভেজ এশিয়ান ফেডারেশন ইনভলানটারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স নামক সংস্থার চেয়ারপারসন। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সবসময় সরব তিনি। সুইজারল্যান্ডে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে রওয়ানা দেওয়ার একদিন আগে ১৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার খুররম পারভেজকে গ্রেফতার করে ভারতীয় পুলিশ। জম্মু-কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগরে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা করা হয় তাকে।
এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন অরুন্ধতী রায়, নোম চমস্কিসহ বিশ্বের খ্যাতনামা ৫২জন শিক্ষক-আইনজীবী-অ্যাকটিভিস্ট। অবিলম্বে খুররমের মুক্তি দাবি করেছেন তারা।
বুধবার ভারতের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের কাছ থেকে আমন্ত্রণপত্র ও বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোর্ডিং পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি কার হয়। জম্মু-কাশ্মির কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটির সভাপতি পারভেজ ইমরোজ তখন বলেছিলেন ‘কর্তৃপক্ষ বলেছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের নির্দেশ দিয়েছে তিনি (পারভেজ) জেনেভাতে যেতে পারবেন না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে জেনেভাবে কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা যাতে বলতে না পারেন সেজন্যই তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।’
ইমরোজের বক্তব্যের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সহমত প্রকাশ করেন ওই বুদ্ধিজীবীরা। তারা কাশ্মিরের বিপন্ন মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে কাশ্মিরবাসীর মত প্রকাশের অধিকার সংরক্ষণে তাগিদ দেন।
৮ জুলাই কাশ্মিরের অনন্তনাগের কোকেরনাগ এলাকায় সেনা ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর যৌথ অভিযানে কমান্ডার বুরহান ওয়ানিসহ তিন হিজবুল যোদ্ধা নিহত হন। এর পর কাশ্মিরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ কাশ্মিরিদের দাবি, বুরহানকে ‘ভুয়া এনকাউন্টারে’ হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে পুলওয়ামা ও শ্রীনগরের কিছু অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়। পরবর্তীতে বিক্ষোভের মাত্রা বেড়ে গেলে কাশ্মিরের দশটি জেলা, এমনকি দূরবর্তী গ্রামেও কারফিউ জারি করা হয়। বিক্ষোভ দেখিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন মানুষ। আর বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা জারি রাখে নিরাপত্তা বাহিনী।
টানা ৫২ দিন পর ২৯ আগস্ট শ্রীনগরের কয়েকটি এলাকা থেকে কারফিউ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও ১৪৪ ধারা জারি থাকে। সর্বশেষ পুলিশের ছররা গুলিতে আহত ১৫ বছরের কিশোর মোমিন আলতাফকে শুক্রবার আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার তার মৃত্যুর পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন শ্রীনগরের হারওয়ানের বাসিন্দারা। তার জানাজা শেষে মানুষ হারওয়ানের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভের ফলে হারওয়ানে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জারি করা হয় কারফিউ। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।
বিক্ষোভের আঁচ যাতে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার জন্য শ্রীনগরের বেশ কিছু উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গত তিন মাসে ও কিশোরের মৃত্যুর পর বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৩ জনে।
সূত্র: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এনডিটিভি, রয়টার্স।
বিবার্তা/ইফতি