মনটা ভীষণ ভাল। ফুরফুরে মেজাজে ঘুরছি শহরের অলিগলি। প্রিয় মানুষকে নিয়ে সবাই ঘুরতে ভালবাসে। তাই প্রিয় বন্ধু শ্যামলও আজ আমার পাশে। দু’বন্ধু মোটর সাইকেল করে ঘুরেই চলেছি। কখনো আমি আর কখনো শ্যামল ড্রাইভ করছে। মোবাইলে গান ছেড়ে এয়ারফোন কানে দিয়ে শুনতে বেশ লাগে।
শহরের শেষপ্রান্তে একটি গলির মাথায় ব্রিজের উপর মোটর সাইকেল থামালো শ্যামল। আমিও নেমে পরলাম। শ্যামল সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে দিয়াশলাই ঠুকে আগুন দিল। আর আমি ব্রিজের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাড়ালাম। শ্যামল বললো এই এলাকাটাকে মানুষ নিষিদ্ধ পল্লী হিসেবে জানে। কী অসামাজিক কাজগুলো এখানে হয়। হঠাৎ ষোড়শী এক মেয়ে এসে দাড়াল ঠিক আমাদের দুইজনের মাঝখানে, যে জায়গাটুকু ফাঁকা ছিল ঠিক সেখানে।
-ভাইজানেরা কি পাকাইতে(ঘুরতে) আইছেন?
-হ্যাঁ, ঘুরতে এসেছি। কথার ভঙ্গি দেখে বুঝে ফেললাম মেয়েটা পতিতা।
-আর কিছু লাগব নাকি?
মুহূর্তে চমকে যায় আমার পৃথিবী। কী বলছে মেয়েটি। কেন বলছে?
নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো কোথাও শান্তি নেই। শান্তির মা যেন মরে গেছে। মানুষের মনের ভিতরে পাথর জমে গেছে।
আমার মুখে অপ্রত্যাশিত কথাগুলো শুনে বিরক্ত হয়ে মেয়েটা বললো, ভাইজান কিছু লাগলে কন।
শ্যামল চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো নদীর দিকে চেয়ে। আমি মেয়েটির কথা না বুঝার ভান করে বললাম- কী আছে তোমার কাছে?
তুমি কি দিতে পারবে?
মেয়েটি বললো-পুরুষ মানুষ যা চায় আমার কাছে তাই আছে।চাইলে দেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত। বলেই মাথা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে মুচকি হাঁসি দেয়। না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করি যেমন?
তারপর আমার কথায় যারপরনাই বিরক্ত হয়ে মেয়েটা শ্যামলকে বলে দোস্ত, সিগারেট টা দাও। সিগারেট এগিয়ে দিলে মেয়েটা টানতে টানতে চলে গেল।
আমি তো রীতিমত অবাক। এ কোন আজব মেয়ে। এ দেশে এমন মেয়েও আছে। আমাকে জানতে হবে। মেয়েটা সম্পর্কে। কেন সে এ পথের বাসিন্দা। জানতে হবে তার সেই মুচকি হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা পাহাড় সমকস্টের রহস্য।
আমার কথা শুনে অবাক হয় শ্যামল। কিন্তু আমার আগ্রহের বাইরে কোনো বিরক্তিবোধ নেই তার। শুধু বললো। সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মোটর সাইকেল নিরাপদে রেখে দু বন্ধু গল্প করে সময় কাটাচ্ছি। ক্রমশ রাত গড়াচ্ছে। ফুটপাতের হোটেলের কাঠের চেয়ারে বসে আছি দুই বন্ধু;। বসে চা, আর মোগলাই পরটা খেয়ে শ্যামল একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টানতে লাগলো। সিগারেটের ধোয়ায় কুণ্ডলী পাঁকিয়ে আশপাশটা ভরে গেল। আর দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস টানতে হচ্ছে দেখে খুব বিরক্ত লাগলো। কেন যে মানুষ সিগারেট খায় ? অযথাই কেন যে আশপাশের পরিবেশটাকে দূষিত করে? বোকা লোকগুলো এর মাঝে কী সুখ খুঁজে পায়, আমার বুঝে আসে না। আবার এ বিরক্তির কথা প্রকাশ করাও যাচ্ছে না। যদি শ্যামল আবার চলে যায়। রাতের আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ। ছেড়া মেঘের ফাঁক ফোঁকর গুলিয়ে মরা জোছনা, এই মধ্যরাতের প্রকৃতিকে বড় অচেনা করে আনে। জলসিক্ত হাসনা হেনার গন্ধ মাদকতা ছড়ায়।
চারদিক তখন একেবারে নিরব নিস্তব্দ; পুরো শহর তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে নিম গাছে একটি কুক পাখি ডেকে চলছে অবিরাম। কুক পাখির ডাকটাই যেন কেমন! শুনলে গা ছম ছম করে ওঠে! কেমন যেন একটা বিষাদ ও বিরহী ভাব ডাকটার মধ্যে। সেই ডাক এই শীতের রাতের নিঃস্তব্দতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
নাভীর উপরের অংশে কাপড় ছাড়া একটা নারীদেহ; মুখে হাত দিয়ে দুই চোখ ডেকে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার ভরাট দেহ যেন বর্ষার নদীর ঢেউয়ের মত ফুলে ফুলে উঠছে! চোঁখ’টা সরিয়ে নিলাম। কি বলবো তাকে ঠিক বুঝে উঠছিলাম না।’ জোরে ধমক দিলাম! এই মেয়ে তুমি কে? কিছু বুঝে উঠার আগেই নারী দেহটি ডাইভ দিয়ে দুই পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
ভাইজান, আপনার আল্লাহর দোয়াই আমারে এই শহরের পতিতা বানাবেন না। আমার কোনো দোষ নাই। আবার ধমক দিলাম, চুপ করো;কাপড় পরে নাও তারপর কি হয়েছে বলো? মেয়েটি পা ছেড়ে পাশের ঝোঁপের আড়াল থেকে শাড়ি নামক এক বস্তু গায়ে জড়িয়ে এলো যা তার রঙ হাঁরিয়েছে অনেক আগে। শাড়িতে কয়েকটি তালি লাগানোর পরেও মেয়েটির দেহ ঢাকতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরপর ফুফিয়ে ফুফিয়ে মাথা নিচু করে এসে সামনে দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখলাম, বয়সে আমার থেকে অনেক বড় হবে, তাই এবার আপনি করেই বললাম। সে মাথা নিচু করেই বলতে লাগলো। সে পাশের বাড়ির মৃত আজাহার আলীর ছেলে সিরাজের স্ত্রী। তার স্বামী বিদেশে কি এক কারখানায় নাকি চাকরি করে। আগে বছর খানেক পর পর বাড়ি আসত, কাপড় নিয়ে টাকা নিয়ে। কিছুদিন থাকত; তাকে আদর সোহাগ করে আবার চলে যেত। দুই’ বছর হয়ে গেল সিরাজ আর আসে না। ওখানে সে আরেকটা বিয়ে করেছে; এখন সে আর আসবে না। সে গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করে। অনেক যুবক এমনকি বয়স্ক বৃদ্ধরাও তাকে কুর্কমের প্রস্তাব দেয়। সে কোনোদিন রাজি হয়নি। অনেকবার ভেবেছে এই শহর ছেড়ে; স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যাবে সে। কিন্তু ঘরে অসুস্থ শাশুড়িকে রেখে কিভাবে যাই ? একটু মায়া স্বরেই বললো সে।
আমি অবাক হলাম! যে স্বামী তার খোঁজ খবর না নিয়ে আরেকটা বিয়ে করে সুখে থাকতে পারে অথচ তারি বৃদ্ধ অসুস্থ মায়ের দায়িত্বভার বহন করছে সে। আমি অবাক দৃষ্টিতে শুনতে লাগলাম তার কথাগুলো। প্রতিদিন একবেলা খেয়ে দিন কাটায় তাও আবার জোটেনা ঠিকভাবে। না খেয়ে ঘরে বসে থাকে সে। বাহিরে বেরুলেই তার জন্য খারাপ প্রস্তাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকেই। সে আর যায় না কাজে। নিজে না হয় না খেয়ে মরে যাব তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু বৃদ্ধ শাশুড়ি ক্ষিদের জ্বালায় যখন ছটফট করে তখন আর সহ্য হয় না। সবাই তাকে শাড়ি, টাকার লোভ দেখায়। কাপড়ের অভাবে অন্য কোথাও কাজের জন্য যেতে পারি না। তাই শাশুড়ির চিৎকারে আজ এই লোকটির কথায় বলতে গিয়ে ..আবার কেঁদে উঠলো।এবার আর ধমক দিলাম না!
কাছে গিয়ে আস্তে তার মাথায় হাত রাখলাম। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে মাথাটা সোজা করলো। তার ঠোট দু’টো মাছির পাখার মত কাপছে; ভয় আর লজ্জায় মেয়েটি এখন আর কথা বলতে পারছে না। আমি বললাম, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। এ কথা আমি কাউকে জানাবো না। কথাটি শুনে মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মনে হলো, হয়তো বুকের ওপর চাপানো একটন ওজনের একটা পাথর এইমাত্র সরে গেল।
জিজ্ঞেস করলাম আপনার নাম কী?
খুব বিরক্ত আর তাচ্ছিল্য স্বরে উত্তর দিল মোহনা। আমি বললাম, চিন্তা করবেন না। এখন আপনি যান। ছিড়া, তালিযুক্ত কাপড়টাকে কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে; ক্লান্ত দেহটা বয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মেয়েটি।
আমার মনে নানা প্রশ্ন উদিত হলো। নিজেকে ভীষন অপরাধী মনে হল, আমি অসাধারণ কেউ নই। সমাজ সংস্কারকও নই, অতি তুচ্ছ একজন মানূষ; তবুও মনের পর্দায় জেগে উঠলো, জীবনে দেখা অনেক মহিলার কথা। শাড়ি ওদের জন্য ফ্যাশন। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজে, মানুষের মাঝে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার এক উপদ্রব। কোণো এক বিশেষ দিনে নিজেকে বিকশিত করে তোলার এক আবরণ। আলমারীতে শোভা করে রাখা এক অহংকার। তাই আজ মনে পড়লো সেই সব শাড়ি পরিহিতাদের কথা; যাদের নামি-দামী বর্ণাঢ্য শাড়ির ঝলকানিতে চোঁখ ঝলসে গিয়েছে কিন্তু পানি আসেনি। অথচ আজ এই ছেড়া-তালিযুক্ত অতিসাধারণ একটি শাড়ি, তা দেখে চোঁখে পানি চলে আসলো, কেন জানি না।
শ্যামল আমার দিয়ে তাকিয়ে বললো, চল এবার চলে যাই। এই নিষিদ্ধ পল্লী থেকে।
আমি বললাম না।
কেন?
ওই মেয়েটাকে তো পেলাম না।
আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করবো।
শ্যামল আবারও একটা সিগারেট টানতে শুরু করলো। কি আর করা খারাপ লাগলেও মেনে নিতে হচ্ছে।
পাশের গলিতে দাড়াতেই প্রায় ৩০-৩২ বছর বয়স্কা এক মহিলা এলো আমাদের দুজনের কাছে। কিছু না বলতেই বেশরমের মত নিজের চেহারা উপস্থাপন করে বলেন-বন্ধু, কিছু করবেন। নাকি এমনি আইছেন?
-ঘুরতে এসেছি। আমি জবাব দিলাম।
-তাইলে একটু ওইদিকে গিয়া খাড়ান।এইদিকে পুলিশ আহে, পরে আপনাগো ঝামেলা হইব। ওইদিকে গিয়া যতক্ষণ ইচ্ছা খাড়াইয়া থাকেন।
-আচ্ছা যাচ্ছি। বলে আমরা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর লক্ষ্য করতে লাগলাম কী কী ঘটছে। মহিলা পিছন থেকে আবার ডাক দিয়ে বললো-বন্ধু শরম পাইতেসেন নাকি? শরম ভাঙলে ডাক দিয়েন।
কিছুক্ষণ পর অন্ধকার একটা গলির ভেতর থেকে ভদ্রলোক গোছের একটা লোক বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসছে। একটু পর একটা ছেলে এলো সাদা শার্ট পরিহিত। ছেলেটাকে আমি এর আগেও দেখেছি। অনেক চেনা মুখ কিছুক্ষণ পর এদিক ওদিক করতেই এক মহিলা তার দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা মহিলার হাত ধরে গলির ভিতর ঢুকে গেল। আবার ৫ মিনিট পর বেরিয়ে এসে ভদ্রলোকের মত হেটে হেটে চলে গেল।
ওড়না বিহীন হলুদ রংয়ের কামিজ স্যালোয়ার পরা মেয়েটি আবার এলো আমাদের কাছে। কিছু বলার আগেই মেয়েটা বললো, কী ব্যাপার এখন পল্লীতে। কার ঘরে যাওয়ার অপেক্ষা।
আমি বললাম এই মেয়ে শোনো
জ্বী বলেন,
কী নাম তোমার?
কেন?
নাম জেনে কী হবে? আপনাদের চাওয়াতো আমার দেহটা...
আমি কথাগুলো শুনে পাথরের মত স্থীর হয়ে গেলাম।
জানতে চাইলাম আবারও তোমার নাম কী
মেয়েটা বিরক্তির হাসি দিয়ে বললো ললিতা।
কে যেন ডাকলো ললিতা, ললিতা।
আসছি,
চলে গেল ললিতা।
তাকিয়ে আছি ললিতার দিকে...
লেখক : সাংবাদিক ও কবি
বিবার্তা/মহসিন