দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহিত্যিকদের সাফল্যের গল্প

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহিত্যিকদের সাফল্যের গল্প
প্রকাশ : ১৬ মে ২০১৬, ১৬:৫৯:৩৭
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহিত্যিকদের সাফল্যের গল্প
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। তারা দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত। দৃষ্টিহীনতার কারণে তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা অন্ধ ব্যক্তি ছিলেন যারা তাদের যোগ্যতা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও অনুপ্রেরণার উৎস।

অন্ধ সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন ইংরেজ কবি জন মিল্টন, গ্রীক কবি হোমার, ফার্সি ভাষার কবি রুদাকি এবং লেখিকা হেলেন কিলার। তারা কাব্য-সাহিত্যে এতবেশি অবদান রেখেছেন যে, যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন তাদের নাম বিশ্ব ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।

জন মিল্টন
প্যারাডাইজ লস্ট কাব্যগ্রন্থের নাম শোনে নাই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলের কাহিনীকে ভিত্তি করে রচিত এই মহাকাব্যটি ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বিখ্যাত এ গ্রন্থটির লেখক ছিলেন অন্ধ কবি জন মিল্টন। তিনি ১৬০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা ছাড়াও তিনি গদ্য লিখতেন। ১৬৭৪ সালের নভেম্বরে তার মৃত্যু হয়।

কবি হোমার
মিল্টনের পর গ্রীক কবি হোমারের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়ে থাকে। ইলিয়ড ও ওডিসি তার বিখ্যাত রচনা। হোমার নামে আদৌ কোনো কবি ছিলেন কিনা তা নিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিংশ শতাব্দীতে এই বিতর্কের অবসান ঘটে এবং তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়।

হেলেন কিলার
অন্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে একটি পরিচিত ও সফল নাম হচ্ছে হেলেন কিলার। অন্ধ, বোবা আর বধির হেলেন মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে বিএ পাস করেন এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৮০ সালের ২৭ জুন হেলেন কিলার জন্মগ্রহণ করেন। আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতই হেলেন কিলারের জন্ম হয়েছিল।

কিন্তু ১৯ মাস বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি বধির ও দৃষ্টিহীন হয়ে যান। ছয় বছর বয়সে হেলেন কিলার টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলের সহায়তায় বধিরদের জন্য বিশেষ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এখানেই শিক্ষক অ্যান সুলিভানের সহযোগিতায় তার পাঠ গ্রহণের কঠিন অধ্যবসায়ের সূচনা হয়।

রেডক্লিফ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের আগেই নিজ আত্মজীবনী ‘দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়। দ্যা ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, আউট অব ডার্ক, মাই রিলিজিয়ন তার বিখ্যাত বই গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৬৮ সালে বিশ্বখ্যাত লেখিকা হেলেন কিলার ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।

লুই ব্রেইল
ব্রেইল পদ্ধতির উদ্ভাবক লুইস ব্রেইল ১৮০৪ সালের ৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন ও ১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

দুর্ঘটনাবশত একদিন বাবার জুতা সেলাইয়ের সুই দিয়ে চোখে আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান লুইস ব্রেইল। অন্ধ হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন দৃষ্টিহীনদের পড়াশোনার গুরুত্ব। এরপর তিনি ব্রেইল রাইটিং পদ্ধতি ডিজাইন করেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই সারা বিশ্বের অন্ধ মানুষ তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন।

মহাকবি রুদাকি
ফার্সি সাহিত্যের জনক হিসেবে পরিচিত কবি রুদাকি। জন্মান্ধ এই কবি নবম শতাব্দীর শেষের দিকে সমরখন্দের রুদাক জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ফার্সি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে, ‘সাতজন কবির সাহিত্য কর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফার্সি সাহিত্য টিকে থাকবে। এই সাতজন কবির একজন হচ্ছেন রুদাকি।

অন্ধ কবি রুদাকিকে স্বভাব কবিও বলা যায়। তিনি গ্রীক কবি হোমারের মতো যেকোনো মজলিসে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনর্গল কবিতা আওড়াতে পারতেন। তার স্মরণশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার যা আওড়াতেন পরে তা হুবহু বলে দিতে পারতেন। তিনি যখন কবিতা আবৃত্তি করতেন তখন তার ভক্তরা তা লিখে রাখতেন।

খণ্ড কবিতা, দীর্ঘ কবিতা ও গজল বা গীতি কবিতা মিলিয়ে তিনি প্রায় তের লাখ কবিতা লিখেছে। পৃথিবীতে এতো বেশি কবিতা খুব কম কবিরই আছে। রুদাকির অধিকাংশ কবিতা সহজ-সরল ভাষায় রচিত এবং নানা উপদেশে পরিপূর্ণ।

রুদাকি শুধু কবি ছিলেন না, তিনি একজন ভালো গায়কও ছিলেন। বেহালায় সুর তুলে নিজের গজল এমন সুন্দর করে গাইতেন যে, সবাই সে গজল শুনে তন্ময় হয়ে যেতেন।

রুদাকিকে ফার্সি সাহিত্যের জনক বলা হলেও তিনি আরবি ভাষায়ও পণ্ডিত ছিলেন। তিনিই প্রথম বিখ্যাত শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘কালিমা ওয়া দিমনা' আরবি সাহিত্যের অমর গ্রন্থ ‘আলিফ লায়লা' ফার্সিতে অনুবাদ করেন।

বাশশার বিন বোরদ
আরবি ভাষার খ্যাতিমান কবি বাশশার বিন বোরদ। সপ্তম শতাব্দীর শেষ দশকে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ক্রীতদাস। কবি বাশশার ছিলেন জন্মান্ধ। কিন্তু তার ছিল অসাধারণ স্মরণশক্তি ও প্রখর বুদ্ধি। তিনি ইরাকের বসরার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষকরা একবার যা বলতেন জীবনে তা কখনো ভুলতেন না। কেবল শোনা এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করেন।

বাশশার বিন বোরদের অধিকাংশ কবিতাই ছিল অন্যায়-অবিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে। অন্যায় করলে তিনি খলিফাকেও খাতির করতেন না। ৯০ বছর বয়সে খলিফার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে আব্বাসীয় খলিফা আল মাহদী তাকে বন্দী করার আদেশ দেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। বন্দী অবস্থায় ৭৮৩ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

ড. তাহা হোসাইন
ড. তাহা হোসাইন একজন অন্ধ পণ্ডিত, যিনি দুই বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন। নিজের প্রতিভার জন্য তিনি মিশরের বিশ্বখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, দুইবার মিশরের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি।

ড. তাহা ১৮৮৯ সালে মিশরের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে গবেষক, সমালোচক, ছোট গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক ছিলেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১০৪টি। আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তাহা হোসাইন মাত্র এগার বছর বয়সে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আধুনিক আরবি সাহিত্যের এই পণ্ডিত ১৯৭৩ সালে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

বিবার্তা/নিশি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com