‘বুড়োর সাথে দেখা করতে এলে যা হয়, বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করেছে রানার। ঢোক গিলে, ঠোঁটে জিভের ডগা বুলিয়ে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল সে’।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র নায়ক মেজর রানা তার বস অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রাহাত খানকে এতটাই ভয় পান যে, প্রতিটি পর্বেই রানাকে যখন রাহাত খানের মুখোমুখি হতে হয়, তখনই এরকম দু’চার লাইনের বর্ণনা থাকে।
এই সিরিজটি গত অর্ধ শতাব্দী ধরে অব্যাহতভাবে প্রকাশ করে আসছেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন। ১৯৬৬ সালের মে মাসে প্রথম প্রকাশিত হবার পর এই নিয়ে ৪৪৬টি পর্ব বের হয়েছে সিরিজটির। গড়ে প্রতি ৪০ দিনে বেরিয়েছে একটি করে পর্ব।
মাসুদ রানাকে বলা যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো, দীর্ঘস্থায়ী ও জনপ্রিয় সুপার-হিরো চরিত্র, যার পক্ষে অসম্ভব বলে কিছুই নেই, যে কখনো পরাজিত হয় না, যার মৃত্যু হয়না। আর এই রানার বসের চরিত্রে রয়েছেন মে. জে. রাহাত খান। তিনি ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ বা বিসিআই নামে একটি কাল্পনিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি।
ঢাকার মতিঝিলে এই সংস্থার প্রধান অফিস। এখানে এসেই সবসময় বসের কাছে রিপোর্ট করতে হয় রানাকে। রাহাত খানকে সবসময়েই বর্ণনা করা হয়েছে অত্যন্ত জলদগম্ভীর এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হিসেবে, যার ঠোঁটে সবসময় থাকে টোব্যাকো পাইপ বা চুরুট।
এই রাহাত খান নামটি লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নিয়েছেন রক্তমাংসেরই এক মানুষের কাছ থেকে। তিনি বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত কথাসাহিত্যিক এবং প্রবীণ সাংবাদিক রাহাত খান। কাজী আনোয়ার হোসেনের সহপাঠী ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু মি. খান। জীবনের একটি সময় সেগুনবাগিচায় কাজী আনোয়ার হোসেনের বাড়ি কাম প্রকাশনা সংস্থাতেই কাটিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এবং দৈনিক বর্তমান নামে একটি সংবাদপত্রের উপদেষ্টা সম্পাদক। তার সঙ্গে আমার কথা হয়, মতিঝিলের একটি বহুতল ভবনে দৈনিক বর্তমান পত্রিকার কার্যালয়ে বসে।
তিনি বলেন, আমি মোটেও সেই মেজর জেনারেল রাহাত খান নই। আমি শুধুই রাহাত খান।
খান বলছিলেন, তার বন্ধু কাজী আনোয়ার হোসেন এই সিরিজগুলো লেখার এক পর্যায়ে তাকে একটি পর্ব দেখতে দিয়েছিলেন। তখন তিনি মফস্বলের একটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। ওই পর্বটি পড়েই তিনি আবিষ্কার করেন, তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে বইয়ের একটি চরিত্র হিসেবে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার যখন দেখা হল তার সাথে তখন তাকে বললাম, এটা কী করেছেন আপনি? তখন তিনি আদরের সঙ্গে আমাকে বললেন, চুপ। আমি বললাম, আমাকে মানায় নাকি, এরকম একটা স্বাস্থ্য নিয়ে মেজর জেনারেল! থ্রি স্টার জেনারেল! তবে যাই হোক, এটা ছিল লেখকের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন। বিশ্বাস করি, এখনো সেই ভালবাসা তার অন্তরে আছে আমার জন্য।
কিন্তু মাসুদ রানা সিরিজগুলোতে রাহাত খানকে যেমন রাশভারী চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে বাস্তবের রাহাত খানও কি সেরকম?
খান বলেন, কিছুটা মিল আছে। আমি কখনো কখনো কোন কোন মহলের কাছে অত্যন্ত রাশভারী। আমার ঘরে সাহসের অভাবে ঢুকতে পারতো না, এরকম বহু ঘটনার কথা আমি পরে শুনেছি। কিন্তু আমি এমনিতে আমুদে মানুষ। আর যখন লিখতে বসে যাই তখন নিবিষ্টভাবে লিখি আমি।
মাসুদ রানা চরিত্রটির নামও লেখক রক্তমাংসের মানুষের কাছ থেকেই নিয়েছেন। সেবা প্রকাশনী থেকেই বের হওয়া রহস্য পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে, নায়কের নামের ‘মাসুদ’ অংশটি লেখক নিয়েছেন প্রয়াত গীতিকবি মাসুদ করিমের নাম থেকে।
আর মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংয়ের নাম থেকে নিয়েছেন ‘রানা’ অংশটি। মাসুদ রানা সিরিজে আরো বহু নিয়মিত চরিত্র রয়েছে। যেমন: সোহেল, সোহানা, রুপা, রাঙার মা, গিলটি মিয়া, ভিনসেন্ট গগল, জর্জ হ্যামিলটন। এদের নামও কি তাহলে বাস্তবের চরিত্র থেকে নেয়া?
সাংবাদিক এবং কাজী আনোয়ার হোসেনের বন্ধু রাহাত খান বলছেন, নওয়াব (কাজী আনোয়ার হোসেনের ডাক নাম) যাদের ভালবাসতেন তাদের নামগুলো বিভিন্ন ভাল ভাল চরিত্রের নাম হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর তার সঙ্গে যারা শত্রুতা করেছে, বেছে বেছে ওদের সবাইকে ভিলেনের নাম দিয়েছেন।
মাসুদ রানা সিরিজের কয়েকজন নিয়মিত এবং দুর্ধর্ষ ভিলেনের একজন কবির চৌধুরী। তিনি একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কিন্তু বিপথে যাওয়া মানুষ। এছাড়া নিয়মিত ভিলেনদের তালিকায় আরো রয়েছেন খায়রুল কবির (কবির চৌধুরীর ছেলে), উ সেন প্রমুখেরা। সূত্র : বিবিসি।
বিবার্তা/এম হায়দার