অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাংলা সাহিত্যে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তিনিই প্রথম পরিচিতি পান। সার্থক মহাকাব্য, গীতিকাব্য, সনেট, পত্রকাব্য, নাটক, প্রহসন রচনা করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’র মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন ইংরেজি সাহিত্যাঙ্গনেও স্থান করে নিয়েছেন।
মহান এই সাহিত্য স্রষ্টা ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রাজনারায়ণ বসু ও মা জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান তিনি। সাগরদাঁড়ির গ্রামের শেখপুর মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়।
শৈশব থেকেই তার মনে ইংরেজি ভাষার কবি হওয়ার তীব্র বাসনা ছিল। তিনি মনে করতেন, বিলেত না গেলে কবি হওয়া যাবে না। তিনি খ্রিষ্টধর্মও গ্রহণ করেন। নামের আগে যুক্ত হয় মাইকেল শব্দটি। ভুল ভাঙলে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন।
বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, তামিল, তেলেগুসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক মহাকাব্য মেঘনাদবদ রচনা করেন।
সাহিত্যকর্ম ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও বেশ আলোচিত মধূসুদন। বিশেষত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও দীন-হীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ, ইংরেজিতে অগাধ দক্ষতা ও আকর্ষণ থেকে ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা শুরু করেও বাংলা ভাষায় ফিরে আসা, ইউরোপ ছেড়ে বাংলায় থিতু হওয়া, সনাতন ধর্ম ছেড়ে খ্রিষ্টান ধর্মগ্রহণ, তাজ্যপুত্র ঘোষিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখনো আলোচিত তিনি।
তার পাণ্ডিত্বের পরিধিও সাহিত্যের ইতিহাসে ঈর্ষণীয় ছিল। বাংলা সাহিত্যে তার আবির্ভাব নাটকের মধ্যে দিয়ে হলেও কাব্যের জন্য তিনি অধিক চর্চিত। মাইকেল মধুসূদন দত্তই প্রথম বাংলা সাহিত্যে সনেট বা চতুর্দশপদী অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন। পদ্মাবতী নাটকে তিনি প্রথম এ ছন্দের ব্যবহার করেন। তার অমিত্রাক্ষর ছন্দের লেখা কাব্যের মধ্যে আছে তিলোত্তমাসম্ভব (১৮৬০), ব্রজাঙ্গনা (১৮৬১) ও বীরাঙ্গনা (১৮৬০)। সনেটের মধ্যে আছে কপোতাক্ষ নদ ও বঙ্গভাষা, যা তার চতুর্দশপদী কবিতাবলীর (১৮৬৬) গ্রন্থভুক্ত।
১৮৫৯ সালে মধুসূদন রচিত পৌরাণিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। তার নাট্যচর্চাকাল খুবই সংক্ষিপ্ত (১৮৫৯-৬১) মাত্র তিন বছর। নাটকের সংখ্যাও বেশি নয়, একটি অসমাপ্তনাটক বাদে পাঁচটি। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ’ বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য দুটি প্রহসন।
এসব সাহিত্যকর্মের মধ্যে মধুসূদনের সমাজবাস্তবতাবোধ, পর্যবেক্ষণ শক্তি, সমাজ সংস্কারের অভিঘাত, কাহিনী চরিত্র ও সংলাপ রচনায় মননের প্রকাশ ঘটে। তবে তৎকালীন নব্য ও সনাতনপন্থী উভয় সমাজে তার এসব অনবদ্য সৃষ্টি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলে প্রহসন রচনা থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন।
এই মহান সাহিত্যস্রষ্ঠা ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃতুবরণ করেন। তার বাড়িটি এখন জাদুঘর। সাগরদাঁড়ি-কপোতাক্ষ ও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেন একইসূত্রে গাঁথা। তার মৃত্যুর সাত বছর পর থেকেই সাগরদাঁড়িতে তার নামে মেলা হয়ে আসছে। তাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য এখনও শেকড় থেকে উৎসারিত হয়ে বিশ্বরূপে আবির্ভাবের প্রেরণা পায়।
তাকে স্মরণ করে তার ভ্রাতুষ্পুত্রী মানকুমারী বসু লিখেছের, যার মধুধ্বনি শুনি মোহিল ভুবন, কেমনে ভুলিবে বঙ্গ, সে মধুসূদন।
বিবার্তা/নিপা/ফারিজ