ভরা ঘাট, ভরা মাঠ।
ভরা মাস শরীর নিয়ে শ্রাবণীলতা হাঁটে।
ফুল্লবাণী বাধা দেয়নি। বরঞ্চ মনে মনে ভৈরবীর নামে মানত করেছে।
ফুল্লরাণীর হাড় জুড়িয়েছে।
শ্রাবণীলতা আনমনে হেঁটে চলে। জগদীশ খুড়া ক্যান ক্যানে মিঁয়ানো গলায় দু'তিনবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।
ফুল্লরাণীর চোখের ভিরমিতে বেশি কথার বলার সাহসও পায়নি।
- পেটেরটা নেমে যাক্। তারপর নাহলে যাস্। এটুকুই বলার সাহস করেছিল খুড়া।
শ্রাবণীলতা হেঁসেছিল মনে মনে।
এখন হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করে, জগদীশ খুড়া আর সে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। হেলথ সেন্টারের দিদিরা এসে কেবল মেয়েদের কথা বলে। আর শ্রাবণীলতার মনে হয় কিছু কিছু জায়গায় মেয়েমানুষ বা বেটাছেলের তফাৎ নাই।
এই যেমন জগদীশখুড়ার যন্ত্রণাটা অদৃশ্য। কারুর ক্ষমতা নাই এই যন্ত্রণার অন্দরে যাওয়ার। হাঁপের রোগে যৌবন গেল। এখন মধ্য বয়সের শেষ গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। যে কোনও এক কাঁধে ভর দিতে হয়, সে কাঁধ যত কর্কশ-ই হোক না কেন? মনের ভাব সেই কর্কশ রাস্তায় হাঁটলে যন্ত্রণা তো হবেই, আসলে ফুল্লরাণীও এমন ছিল না। হাঁ-মুখ পেটটা ভালবাসাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে করতে তলানিতে নিয়ে আসে কিছু স্মৃতিগন্ধ।
মাঝে মাঝে ফুল্লরাণী মাটির দাওয়ায় বনাজী তেল মাখতে মাখতে সেই স্মৃতিগন্ধ টের পায়। কিন্তু মাটির দাওয়া তো বন্যার জলে ভাসে। ভেসে আসে ছেঁড়া পলিথিন। কেঁচো আর এখন আসে না। একফালি উঠোনে তাই আর জীবনশষ্যের দেখা পাওয়া যায় না। হাড় বখাটে পুঁইঝাড় বেড়ে ওঠে। ছেঁড়া পলিথিনের ফাঁকেও যে পুঁইডগা উঠোন ছড়ায়- এইবা কম কিসে? বেশ কটা দিন তরতরিয়ে পেট তো চলে।
শ্রাবণীলতা হাঁটে। পেছনে রেখে আসে কিছু মৃত্যু যা তার দৈনন্দিন যাপনকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। সামনে চলে আসে অজস্র চিন্তা, বসতিসংকট, পেটের মধ্যে নিবারণের উত্তরাধিকার। হ্যাঁ, নিবারণের উত্তরাধিকারই বটে। শ্রাবণীলতা একে নিজের বলে কি করে মানবে?
হাটে, মাঠে, ঘাটে ফুল্লরাণীর সমাজ, জগদীশ খুড়াদের সমাজ বসত করে। শ্রাবণীলতার শরীরে বেড়ে ওঠা, তার শারীরিক ভালোমন্দের রসে সিঞ্চিত একটি স্পন্দন লালিত পালিত হবে শ্রাবণীলতার হাত ধরে- কিন্তু ঔরসের উত্তরাধিকার সূত্রে সেই স্পন্দন সমাজে জায়গা পাবে।
মুহূর্তের নিঃসরণের মধ্যেও একটি আস্ত তন্ত্রসাধনা প্রতিনিয়ত কাজ করে। তাই শ্রাবণীলতার আঁচলে নুনজলের কারুকাজ থাকে।
শ্রাবণীলতা হাঁটে।
মধুরাঘাটে সে শরীরটা জিরোতে চায়। মাকে মনে পড়ে। মায়ের মুখে শুনেছিল ভরা শ্রাবণে তার জন্ম। এটা অবশ্য কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। তবুও সে মনে রেখেছে, কারণ মাকে সেদিন কলসি ভরা জল আনতে হয়েছিল নিবারণের মতো তার বাপের চৌদ্দ গোষ্ঠীর পেটের পিণ্ডি চটকানোর জন্য। ঘরে এসেই শ্রাবণীলতা খসে পড়ে।
কিন্তু মরণ!
একেবারে সুস্থ তরতাজা শ্রাবণীলতা।
মধুরাঘাটে বননিম গাছটা দেখে ঘুম পায় শ্রাবণীলতার। গাছের ছায়ায় বড় মায়া। মায়ের মত আগলে রাখে।
ঘুমায় শ্রাবণীলতা।
শ্রাবণীলতার অন্দরে ঘাস শিশিরের বসতবাড়িতে ছোট্ট শ্রাবণীলতা অপেক্ষা করে আরেক নিবারণের, আরেক ফুল্লরাণীর আরেক জগদীশখুড়ার।
বিবার্তা/জিয়া