সীতাংশু রায় মারা গেলেন। ম্যাসিভ হার্ট আ্যাটাক। ডাক্তার এবং ভাইপোদের দুয়ো দিয়ে কয়েক মুহূর্তের কষ্টে চলে গেলেন সীতাংশু। থেকে থেকে সকলেরই মনের হতে লাগল- এত বড় হৃদয়ের মানুষ--আজীবন হইহল্লা আর আনন্দের মানুষটি কেনই বা হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে চখের পলকে পরাস্ত হলেন। সুদর্শন, সুশিক্ষিত এবং খোলা মনের মানুষ ছিলেন সীতাংশু।
কোনও আড্ডায় তাঁর বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলে নিজেই হাসির হল্লা ছুটিয়ে বলতেন—‘কুমোরটুলিতে বায়না দিয়েছিলুম, কিন্তু সময়মত আর ডেলিভারি নেওয়া হয়ে ওঠেনি।’
সাধারণ দুঃখ-টুঃখর ধার ধারতেন না কখনও। রন্টু অন্তত তার বাইশ বছরের জীবনে সোনাকাকুর ওসব দেখেনি। তার চোখে সোনাকাকুই আদর্শ মানুষ। আড়ালে আলোচনা করত অনেকেই--এত উপার্জন, এরকম বড় মাপের জীবন অথচ শেষ বয়সে দেখার লোক রইল না। মুখাগ্নির অধিকারীও রইল না কেউ। কানে গেলে খোলা হাসিতে তুবড়ি ছোটাতেন সীতাংশু – ‘এত ভালোমন্দ খাদ্য খেয়ে যে মুখে সুখ পাচ্ছি, তাতে আগুন দেওয়ার চিন্তা আমি করি না। সংস্কারের কথা যদি বলো, তবে ওই রন্টুই আমার ভরসা।’ কাছে থাকলে রন্টুকেই সাক্ষী মানতেন- ‘কী রে পারবি না আমার মুখে আগুন দিতে?’ এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে চোখ ভিজে যেত রন্টুর।
শ্রাদ্ধের আয়োজনের মধ্যে সত্যি সত্যিই থেকে থেকে চোখ ভিজে যেতে লাগল রন্টুর। সব দিক থেকে এই পরিবারের সেরা মানুষটি-ছাতার মতো ছায়া দেওয়া মানুষটি এভাবে কাউকে কোন সুযোগ না দিয়ে চলে যাবেন, তা ভাবা যায় না। হটাৎ দেখা গেল এহেন মানুষটির কোন ছবি এ বাড়িতে নেই। কাজের দিনে মালা দিয়ে সাজিয়ে রাখার মতো ছবি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। পারিবারিক সব ব্যাপারেই যাঁর উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল, তাঁর ছবি রাখার কথা কেউই সেভাবে ভাবেনি।
নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েও বাড়তি এই কষ্টটা ভুলতে পারছিল না রন্টু। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়েও ইতি-উতি তাকাল। যদি কোন দেওয়ালে সোনাকাকুর মুখটা ভেসে উঠে। দু’ এক জায়গায় মুখ ফুটে বলেও ফেলল ছবির কথা। কিন্তু কোনও সুরাহা হল না। শেষে গেল ল্যান্সডাউনে। একটা ফ্লাটে রাঙামাসি যেখানে একা থাকেন। মেমোরিয়ালে পড়ান। মায়ের এই বোনটি অনেকের তুলনায় আলাদা। রন্টুকে খুব পছন্দও করেন। ঘরে ঢুকে রাঙামাসির ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত চেহারা দেখে চমকে উঠল রন্টু। এলোমেলো চুল, চোখমুখ বসে গেছে। এমন বিষাদ-প্রতিমা হিসেবে রাঙামাসিকে কখনও দেখেনি। সোনাকাকুর কথা বলতে বলতে ছবির কথাটাও তুলল রন্টু। মুহূর্তের মধ্যে যেন দপ করে ক্ষেপে উঠলেন রাঙামাসি—‘কে, কে বলেছে আমার কাছে ছবি আছে, আমি ওটা দিতে পারব না।’
রন্টু অপ্রস্তুত। কার্যকারণ বুঝতে না পেরে শুধু বলল—‘না, মানে সকলকেই তো বলেছি, যদি একটা ছবি পাওয়া যায়। তোমাকেও সেভাবেই—’
নিমন্ত্রণপর্ব সেরে নিরাশ হয়ে বেরিয়ে আসছিল রন্টু। দরজার কাছে আসতেই রাঙামাসি ডাকলেন – ‘একটু দাঁড়া।’ তারপর গোপন সিন্দুকে আগলে রাখা অমুল্য সঞ্চয়ের মতো ছবির প্যাকেটটা নিয়ে এলেন। সব মোড়ক খুলে সোনাকাকুর অসম্ভব সুন্দর একখানা ছবি সামনে মেলে ধরে রাঙামাসি বললেন – ‘কাজ হয়ে গেলে আমার জিনিস আমায় ফিরিয়ে দিয়ে যাস, বাবা। এটুকু ছাড়া আমার তো আর কিছুই রইল না।’
এহেন মিনতির জবাবে নিঃশব্দ কথা দিয়ে রাস্তায় নামল রন্টু। ফিরতে ফিরতে তার কেবলই মনে হতে লাগল--সোনাকাকু কুমোরটুলিতে বায়না দিয়ে এমন একটি প্রতিমার ডেলিভারি নিলেন না কেন?
বিবার্তা/জিয়া