পঞ্চকবির একজন রজনীকান্ত সেন

পঞ্চকবির একজন রজনীকান্ত সেন
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৬, ১১:০৩:১১
পঞ্চকবির একজন রজনীকান্ত সেন
হাবিবুর রহমান স্বপন
প্রিন্ট অ-অ+
রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার বেলকুচি উপজেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) সেনভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ভক্তিমূলক ও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশপ্রেমই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়। 
 
দুই বাংলায় পরিচিত পঞ্চকবির এক কবি তিনি। উল্লেখ্য অপর চার জন হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
 
রজনীকান্ত ছিলেন পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর তৃতীয় সন্তান। গুরুপ্রসাদ চারশত বৈষ্ণব ব্রজবুলী কবিতাসঙ্কলনকে একত্রিত করে ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামক কীর্তন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও ‘অভয়াবিহার’ গীতিকাব্যের রচয়িতা ছিলেন তিনি। মনোমোহিনী দেবী সুগৃহিণী ছিলেন। রজনীকান্তের জন্মের সময় তিনি কাটোয়ায় কর্মরত ছিলেন। শৈশবকালে রজনীকান্তের বাবা অনেক স্থানে চাকরি করেন। 
 
শৈশবে রজনী খুবই চঞ্চল ও সদাসর্বদাই খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তাঁর নৈতিক চরিত্র সবার আদর্শস্থানীয় ছিল। তিনি খুব বেশি সময় পড়তেন না। তারপরও পরীক্ষায় আশাতীত ফলাফল অর্জন করতে পারতেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি তাঁর দিনপঞ্জি বা ডায়রিতে উল্লেখ করেছেন ‘আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’ 
 
বিদ্যালয় ছুটির সময় প্রতিবেশীর গৃহে সময় ব্যয় করতেন। সেখানে রাজনাথ তারকরত্ন মহাশয়ের কাছ থেকে সংস্কৃত ভাষা শিখতেন। এছাড়া গোপালচন্দ্র লাহিড়ীকে তিনি তাঁর শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছিলেন। 
 
রজনীকান্ত রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এর ফলে তিনি প্রতিমাসে দশ রুপি বৃত্তি পেতেন। পরবর্তীতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এফ.এ পাস করে সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৮৯ -তে বি.এ পাস করে করেন। অতঃপর একই কলেজ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পরিবারকে সহায়তা করার জন্য আইন বিষয়ে বি.এল ডিগ্রী অর্জন করেন রজনীকান্ত সেন। এরপর তিনি রাজশাহীতে আইনপেশা শুরু করেন। ব্রিটিশ ভারতের সরকার কর্তৃক তিনি নাটোর, নওগাঁ ও বরিশালে মুন্সেফ হিসেবে চাকরি করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর ভাল না লাগায় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
 
তিনি হিরন্ময়ী দেবী নাম্নী এক বিদূষী নারীকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে (৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) বিয়ে করেন। হিরন্ময়ী দেবী রজনীর লেখা কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনো কখনো তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত ও সমালোচনা ব্যক্ত করতেন। তাঁদের সংসারে চার পুত্র- শচীন্দ্রকান্ত, জ্ঞানেন্দ্রকান্ত, ভুপেন্দ্রকান্ত ও ক্ষীতেন্দ্রকান্ত এবং দুই কন্যা- শতদলবাসিনী ও শান্তিবালা। কিন্তু ভুপেন্দ্র খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা রেখে পরদিনই রচনা করেন -
 
তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোকবারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷
 
রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে কিশোর রজনীকান্তের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই আলোচনা-পর্যালোচনাই তাঁর ভবিষ্যত জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। ভাঙ্গাকুঠি গ্রামের তারকেশ্বর চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর বন্ধু। তাঁর সঙ্গীত সাধনাও রজনীকে সঙ্গীতের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ গড়তে সাহায্য করে। 
 
শৈশবকাল থেকেই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বাবলীল ভঙ্গীমায় বাংলা ও সংস্কৃত - উভয় ভাষায়ই কবিতা লিখতেন। তিনি তাঁর রচিত কবিতাগুলোকে গান আকারে রূপ দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান পরিবেশন করতেন। রজনীকান্তের কবিতাগুলো স্থানীয় উৎস, আশালতা প্রমুখ সংবাদ-সাময়িকীতে অনেকবার প্রকাশিত হয়েছিল। 
 
কলেজ জীবনের দিনগুলোতে তিনি গান লিখতেন। অভিষেক অনুষ্ঠান ও সমাপণী বা বিদায় অনুষ্ঠানেই গানগুলো রচনা করে গাওয়া হতো। তিনি তার অতি জনপ্রিয় গানগুলো খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রচনা করতে সক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। তেমনি একটি গান রাজশাহী গ্রন্থাগারের সমাবেশে মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে রচনা করেছিলেন: 
 
‘তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা;
ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত-মণিরঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা৷’
 
১৫ বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তাঁর অপূর্ব কবিত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষত সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটকে অভিনয় ইত্যাদিতে গভীরভাবে মনোঃসংযোগ ঘটান। এরই প্রেক্ষাপটে রাজশাহীতে অবস্থানকালে তাঁর বন্ধু ও বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় এবং স্ত্রীর কাছ থেকে বেশ সক্রিয় সমর্থন পান। 
 
রজনীকান্ত ওকালতি পেশায় গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এ সময় থেকে মৃত্যুর প্রায় এক বছর পূর্ব পর্যন্ত রজনীকান্তের জীবন এক অখণ্ড আনন্দের খনি ছিল। তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভাই তাঁকে অমর করে রেখেছে। সঙ্গীত-রচনা করা তাঁর পক্ষে এমনই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি অবহেলায় উপেক্ষায় অতি উৎকৃষ্ট সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। সঙ্গীতের প্রতি তার প্রবল আগ্রহের কথা ব্যক্ত করে তিনি শরৎ কুমার রায়কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন:
 
‘কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল।’
-একান্ত অনুগত
শ্রীরজনীকান্ত সেন
 
স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর গান ছিল অসীম প্রেরণার উৎসস্থল। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউনহলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিলাতি পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ। ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষতঃ আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরি বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতে তৈরি কাপড়ের তুলনায় তেমন মসৃণ ও ভাল ছিল না। এর ফলে কিছুসংখ্যক ভারতবাসী খুশি হতে পারেননি। এই কিছুসংখ্যক ভারতীয়কে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তার বিখ্যাত  দেশাত্মবোধক ও অবিস্মরণীয় গান:
 
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দ্বীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই৷’
 
এই একটি গান রচনার ফলে রাজশাহীর পল্লীকবি রজনীকান্ত সমগ্র বঙ্গের জাতীয় কবি- কান্তকবি রজনীকান্ত হয়ে উঠলেন ও জনসমক্ষে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেন। প্রায়শই তাঁর গানগুলোকে কান্তগীতি নামে অভিহিত করা হতো।
 
এ গানটি রচনার ফলে পুরো বাংলায় অদ্ভুত গণআন্দোলন ও নবজাগরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। গানের কথা, সুর ও মাহাত্ম্য বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করায় রজনীকান্তও ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গও গানটিকে উপজীব্য করে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় কর্ম পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় বিপ্লবী নেতারাও পরবর্তী বছরগুলোয় বেশ সোৎসাহে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গানটিকে ঘিরে।
 
পরবর্তীকালে তিনি প্রায় একই ঘরানার আরো একটি জনপ্রিয় গান রচনা করেন: 
 
‘আমরা নেহাত গরীব, আমরা নেহাত ছোট,-
তবু আছি সাতকোটি ভাই,-জেগে ওঠ!’
 
গানটির পরবর্তী চরণগুলো ছিল মূলত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন সংক্রান্ত। বিখ্যাত আরো একটি গান তিনি প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে রচনা করেছিলেন:
 
‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে;
তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে৷’
 
রজনীকান্ত শৈশবকাল থেকে সঙ্গীতপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কোথায়ও কোন সুমধুর সঙ্গীত শুনলেই তিনি সুর, তালসহ তৎক্ষণাৎ তা কণ্ঠস্থ করতে পারতেন। তাঁর পিতা গুরুপ্রসাদ সেন একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ফলে পিতার সাহচর্য্যেই শৈশবে সঙ্গীত অনুশীলন করার সুযোগ ঘটে তাঁর। বস্তুত কাব্যের চেয়ে গানের ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব অধিক। যৌবনে সঙ্গীত রচনায় বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় প্রদান করেন রজনীকান্ত।
 
অক্ষয়কুমারের বাসভবনে আয়োজিত গানের আসরে তিনি স্বরচিত গানের সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। রাজশাহীতে অবস্থানকালে রজনীকান্ত সেন তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি দ্বিজেন্দ্রলালের কণ্ঠে হাসির গান শুনে হাসির গান রচনা শুরু করেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গান রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তিনি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখনীর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ফলে তিনিও তাঁর মতো করে সমগোত্রীয় লেখা লিখতে শুরু করেন।
 
তাঁর রচিত গানগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে ভাগ করা য়ায় -দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান ও হাস্যরসের গান।
 
রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক। স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) চলাকালে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ গানটি রচনা করে অভূতপূর্ব গণআলোড়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
 
কবি হিসেবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন রজনীকান্ত সেন। নির্মল আবেগ ও কোমল সুরের ব্যঞ্জনায় তাঁর গান ও কবিতাগুলো হয়েছে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ।
 
রজনীকান্ত সেন ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্তের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বুড়ো বাঙ্গাল কবিতাটি তেমনই একটি। কবিতাটি রস-নিবেদনে এবং ব্যঙ্গ চাতুর্যতায় - এক কথায় অপূর্ব:
 
‘বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা, ঢাইল্যা দিচি পায়;
তোমার লগে কেমতে পারুম, হৈয়্যা উঠছে দায়।
আরসি দিচি, কাহই দিচি, গাও মাজনের হাপান দিচি,
চুলে বান্দনের ফিত্যা দিচি, আর কি দ্যাওন যায়?’
 
তিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ করেছিলেন। তৎকালীন সামাজিক সংস্কার, শিক্ষিত সমাজের বিকৃতি ইত্যাদি উপকরণ নিয়ে ব্যঙ্গ করার সাথে সাথে গ্লানিমুক্ত নির্দোষ হাসির কবিতাও তিনি লিখেছেন। এদেশের ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি প্রচ্ছন্ন শ্লেষের সাথে কৌতুকরসের পরিবেশনা রয়েছে পুরাতত্ত্ববিৎ কবিতায়:
 
‘রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি,
টোডরমলের কটা ছিল নাতি,
কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।
আকবর শাহ কাছা দিত কিনা,
নূরজাহানের কটা ছিল বীণা,
মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।’
 
গল্প, কাহিনী বা নিছক কলাশিল্পের সাহায্যে কবি জ্ঞানগর্ভ নীতিকথা বা তত্ত্ব প্রচার করেন। নীতিকথার তীব্রতা কল্পনার স্পর্শে যাতে কোমল ও কান্তরূপ পরিগ্রহ করে, তাই কবি হৃদয়ের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সেই দৃষ্টিকোণে রজনীকান্ত সেনের অমৃত কাবগ্রন্থটি একটি সার্থক নীতি কবিতার অন্তর্ভুক্ত। উপযুক্ত কাল কবিতায় তিনি লিখেছেন:
 
‘শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
চৈত্রমাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,
কবে সেই  হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?’
 
রজনীকান্তের গ্রন্থসমূহ: বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫), অমৃত (১৯১০), এছাড়াও ৫টি বই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে অভয়া (১৯১০), আনন্দময়ী, (১৯১০) বিশ্রাম, (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), শেষদান (১৯১৬)।
 
এগুলোর মধ্যে বাণী এবং কল্যাণী গ্রন্থটি ছিল তাঁর গানের সঙ্কলন বিশেষ। অমৃত কাব্যসহ দু'টি গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে শিশুদের পাঠ্য উপযোগী নীতিবোধ সম্পর্কীয় ক্ষুদ্র কবিতা বা ছড়া। রবীন্দ্রাথ ঠাকুরের কণিকা কাব্যগ্রন্থটিই তাকে অমৃত কাব্যগ্রন্থ রচনা করতে ব্যাপক প্রভাবান্বিত করেছে।
 
১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর ক্যান্সার শনাক্ত হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে ইংরেজ ডাক্তার ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করান। এতে তিনি কিছুটা আরোগ্য লাভ করলেও চিরতরে তাঁর বাকশক্তি হারান। অপারেশন পরবর্তী জীবনের বাকী দিনগুলোয় হাসপাতালের কটেজেই কাটাতে হয়। ১১ জুন, ১৯১০ তারিখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রজনীকান্ত সেনকে দেখার জন্যে হাসপাতাল যান। এ উপলক্ষে হাসপাতালে বসেই রজনীকান্ত একটি কবিতা রচনা করেন:
 
‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চুর,
তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর৷
ঐ গুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,
তাই সব বাধা সরায় দয়াল করেছে দীন আতুর।’
 
বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে ১৯১০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় রজনীকান্ত সেন ইহলোক ত্যাগ করেন। 
 
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
 
বিবার্তা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com