‘যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।
হ্যাঁ, যতকাল ধরে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী যমুনা বহমান থাকবে, ততকাল বাঙালী জাতির অন্তরে লালিত হবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নামই নয়, একটি মুক্তির পথ, একটি বিশ্বাসের নাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন একটি ব্যক্তির নাম চলে আসে,যে ওই জাতির ক্রান্তিকালে জাতিকে সঙ্কট থেকে মুক্তির দিশা দেখিয়ে উত্তরণের পথে নিয়ে যায়। এমন একজন মহামানব বা মহান ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যে কোনো মহামানব বা মহানায়কের মাহাত্ম্য বর্ণনা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রভাষার শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। বাংলা ভাষার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা ভাষার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের মাধ্যমেও উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা।
অন্নদাশঙ্কর রায় প্রথম কবি, যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান রচনা করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা। যেসব রচনায় উঠে এসেছে শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্বের কথা।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেসব কবিরা কবিতা লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম কবি মহাদেব সাহা। কবিতায় মহাদেব সাহা দেখিয়েছেন বাংলার প্রকৃতি, ফুল, পাখি, নদী, আকাশ সবই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। মহাদেব সাহা দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেন:
‘আমি আমার সমস্ত কবিত্ব শক্তি উজাড় করে
যে কবিতা লিখেছি তার নাম শেখ মুজিব,
এই মুহূর্তে আর কোনো নতুন কবিতা লিখতে পারবো না আমি
কিন্তু এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল
শাপলা-পদ্ম-গোলাপ সেই গোলাপের বুক জুড়ে
ফুটে আছে মুজিবের মুখ
এদেশের প্রতিটি পাখির গানে মুজিবের প্রিয় নাম শুনি,
মনে হয় এরা সকলেই আমার চেয়ে আরো বড়ো কবি।
শেখ মুজিবের নামে প্রতিদিন লেখে তারা নতুন কবিতা।’
(শেখ মুজিব আমার নতুন কবিতা)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ট্র্যাজিক মৃত্যুর পরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে’ শিরোনামে কবিতা রচনা করেন অন্নদা শংকর রায়। তিনি বলেন:
‘নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো
করে যদি তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন
জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরেই নিধন।
নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শিরোনামের কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি আবেগী হয়ে উচ্চারণ করেছেন:
‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
... ... ... ... ... ... ... ... ...
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তিনি কবিতায় দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালি জাতির পথ প্রদর্শক। জাতির মুক্তি নায়ক হিসেবে কবি শেখ মুজিবের কথা উচ্চারণ করেছেন ‘স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হল’ কবিতায়। কবি বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেন:
‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে ,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন ৷
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা ৷
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতা খানি
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
‘বাঙালি, একটি ফিনিক্সপাখি’ শিরোনামের কবিতায় কবি আখতারুজ্জামান আজাদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে বলেছেন বাঙালি জাতির সপরিবারের হত্যা। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের কথা কবির মনে পরে প্রতিটি পথ চলায়। কবি বলেন:
‘আমরা বাহান্নতে মরেছি দলে দলে,
আমরা একাত্তরে মরেছি ঝাঁকে ঝাঁকে,
আমরা পঁচাত্তরে মরেছি সপরিবারে।
... ... ... ... ... ... ... ...
পরাজিত শক্তি যখন হেঁটে বেড়ায় বিজয়ীর বেশে,
যখন ফুলেরা কাঁদে, হায়েনারা হাসে;
যখন মানুষ ঘুমায়, পশুরা জাগে;
তখন আমার ঠিকানায় আসে সেই পুরনো পত্র,
তখন আমার কানে ভাসে সেই পুরনো ছত্র
‘এ বা রে র সংগ্রাম আমাদের মু ক্তি র সংগ্রাম!
এ বা রে র সংগ্রাম স্বা ধী ন তা র সংগ্রাম!
জ য় বাং লা!।’
কবি শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন অসংখ্য। রঙ্গবন্ধুর মহা প্রয়াণেও যেন তিনি বেঁচে আছেন প্রকৃতির মাঝে এমনটিই তিনি বলেছেন ‘তিনি এসেছেন ফিরে’ কবিতায়:
‘লতাগুল্ম বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনা বিহবল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।
এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে।’
মানুষের মনের অজান্তেই কেমন করে যেন মোহন বাগান কাঁটাবন হয়ে যায়! অতিথিরা কেবল হয়ে পড়ে মৃত অথবা শত্র! আয়নায় নিজের মুখও পরিষ্কার দেখা যায় না- যেন ভাঙা আয়না। আস্থা আর নির্ভরতার জায়গা কমছে সারা পৃথিবীজুড়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মতো ব্যানারে ব্যানারে, কিংবা পোস্টারে, ফেস্টুনে লেখা কথাগুলো বাতাসে মেলাচ্ছে তাদের করুণ-ব্যর্থ সুর। মিথ্যার ডারিতে ভরে উঠছে পৃথিবী; বেঁচে থাকতেও যেন এক ধরনের ঘৃণা ধরেছে সজাগ মানুষের মনে! কেবল বমি বমি লাগে- ঘেন্নায়। জীবনানন্দের মতো, চারপাশের অশুভ নৃত্যপরতা দেখতে দেখতে, শামসুর রাহমানও গভীর গভীরতর এক অজানা অসুখে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছিলেন। জানাচ্ছেন সে কথা তিনি:
‘ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী
আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, গাছগাছালি
আর জানে ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্নসম্ভব
আমার ঘরের চার দেয়াল। অসুস্থতা নেকড়ের মতো
চিবিয়ে খাচ্ছে আমার মেদমজ্জা।’
‘অন্ধের দেশে কে দেবে অভয়?’ অথবা, ‘কান পেতে থাকি দীপ্র কণ্ঠ শোনার আশায়,/ কাকের বাসায় ঈগলের গান কখনো যায় কি শোনা?’ প্রভৃতি কথামালায় কবি নির্মাণ করতে চান একটি পরিবারের, একটি জাতির দুর্দশার ভেতর থেকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবার প্রবল প্রত্যয়।
শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে পারেননি; তাবে তাঁর অগণিত ভক্ত পাঠক তা অবলোকন করেছে। যে মাটিতে জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছিল, সেই মাটিই তার দায় শোধ করেছে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। জাতীয় ঐতিহ্যকে চেতনায় ধারণ করে কবি শামসুর রাহমানসহ সকল কবি-সাহিত্যিকরা আমাদেরকে যে কথামালা শুনিয়েছেন, তা বিষয়-ভাবনা এবং পরিবেশনশৈলীর দিক থেকে সত্যিই চমৎপ্রদ এবং অভূতপূর্ব।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/জিয়া