শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে সৌন্দর্য পূজারিদের অন্যতম উপাসনা মিসরের রূপের রানী ক্লিওপেট্রাকে ঘিরে। তাঁর সৌন্দর্যের মায়াজালে আটকা পড়েছে বিশ্বের অনেক নামজাদা মানুষ। প্রাচীন মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী তিনি। প্রত্যয়ী ক্ষমতা, সহজাত রসবোধ, প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষ এবং তা বাস্তবায়নের অদম্য ইচ্ছেশক্তির জোরে তিনি সর্বকালের সেরা নারীদের কাতারে স্থান করে নিয়েছিলেন। এ কালে এসেও তাঁকে মনে করা হয় সম্মোহনী সৌন্দর্য আর সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে।
সেই ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ এবং সাম্রাজ্যের বড় অংশ এখন ঘুমিয়ে আছে ভূমধ্যসাগরের নিচে। ঐতিহাসিকদের মতে‚ মিসরীয় কোবরার বিষাক্ত দংশনে এই প্রাসাদেই আত্মহত্যা করেছিলেন সুন্দরী ক্লিওপেট্রা।
ইতিহাস বলে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে মিসর জয়ের স্মারক হিসেবে এক বন্দর নগরী পত্তন করেন গ্রিক বীর আলেকাজান্ডার। তখন ওই শহরের নাম রাখা হয় আলেকজান্দ্রিয়া। এর পর থেকে মিসর শাসন করতে থাকে গ্রিসের টলেমাইন বংশ। আর এই বংশেরই মেয়ে ছিলেন ক্লিওপেট্রা। যিনি প্রথমে তাঁর বাবা ইরিয়াক-২ এর সঙ্গে‚ পরে একাই ফারাও হিসেবে বসেন মিসরের সিংহাসনে।
ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা জানায়, মিসর থেকে রোমানদের দূরে রাখতে রোমান সম্রাটদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন চতুর ক্লিওপেট্রা। মিসরীয় রীতি অনুযায়ী তাঁর বিয়ে হয়েছিল নিজের ভাই টলেমির সঙ্গে।
এর কয়েক বছর পর জুলিয়াস সিজার পম্পেই বিজয়ের পর মিসরে আসেন। তিনি প্রেমে পড়েন ক্লিওপেট্রার। জুলিয়াস সিজারের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর সমর্থনে টলেমি রাজ্যচ্যুত হন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। ফলে এককভাবে রাজ্যশাসন ভার পেয়ে যান ক্লিওপেট্রা।
এরপর এক যুদ্ধে সিজারের মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা সম্পর্ক গড়ে তোলেন মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে। কিন্তু একসময় অ্যান্টনির বিপক্ষ শিবির‚ জুলিয়াস সিজারের বংশধর জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানাস আক্রমণ করেন মিসর।
মিসরের এক্টিয়ামের সেই যুদ্ধে হেরে আত্মহত্যা করেন মার্ক অ্যান্টনি। প্রিয়তম অ্যান্টনির মৃত্যু আর সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী জেনে একই পথে বেছে নেন ক্লিওপেট্রাও। ঐতিহাসিকদের মতে সেটা ইচ্ছেকৃতভাবে বিষধর সাপের দংশন খেয়ে।
অবশ্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, হেমলক‚ আফিম ও অন্য বিষাক্ত জিনিসের মিশ্রণ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ক্লিওপেট্রা। যার মারণক্ষমতা আগেই পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছিল তাঁর দাসীদের ওপর।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর ফারাও হন তাঁর ছেলে সিজারিয়ান। কিন্তু সে অল্প কয়েকদিনের জন্য। তাঁকে হত্যা করে মিসরের শাসনভার নেন জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানাস। মিসরে শুরু হয় রোমান শাসন।
ইতিহাসের এটুকু মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু এত কিছুর পর কোথায় গেল ক্লিওপেট্রার সেই জমকালো প্রাসাদ? সেই প্রাসাদের খবরও গত শতকের শেষভাগে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন ফরাসি পুরাতত্ত্ববিদ ফ্রাঙ্ক গদিও।
সম্প্রতি ছিল ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ পুনরায় আবিষ্কারের ২৫ বছরপূর্তি। এই দিনটি উপলক্ষে পুরাতত্ত্ববিদ ফ্রাঙ্ক গদিও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দি ইনডিপেনডেন্টের কাছে।
সাক্ষাৎকারে গদিও জানান, গ্রিক ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর লেখায় তিনি পড়েছিলেন ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ছিল মিসরের অ্যান্তিরহোদোস দ্বীপে। এই দ্বীপের অস্তিত্ব তখনো আধুনিক দুনিয়া জানে না। খুঁজতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক আবিষ্কার করলেন‚ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প এবং সুনামিতে ক্লিওপেট্রার প্রাসাদসহ এই দ্বীপটিকে গ্রাস করে নিয়েছে ভূমধ্যসাগর। আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উপকূলেই ছিল এই দ্বীপ। ওই ভূমিকম্পে তলিয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘরও। যা ছিল প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরের গভীরে পাওয়া গেল ক্লিওপেট্রার প্রাসাদের অস্তিত্ব। কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে বলা হলো‚ এই প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল রানির জন্মেরও ৩০০ বছর আগে। দেখা গেল পানির অতলে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন নগরী, লাল রঙের মিসরীয় গ্র্যানাইটে তৈরি দেবী আইসিসের মূর্তি‚ ক্লিওপেট্রার পরিবারের সদস্যদের মূর্তি‚ প্রচুর অলঙ্কার‚ বাসনপত্র এবং স্ফিংক্সের দুটি মূর্তি।
সাগরের নিচে প্রায় এক হাজার ৪০০ বছরের বালি আর কাদা মাখা ইতিহাসের অমূল্য এই দলিলের বেশ কিছু নিদর্শন তুলে আনা হয়েছে জনসমক্ষে। কিন্তু প্রতিকূলতার জন্য বেশির ভাগই রয়ে গেছে পানির নিচে। ফ্রাঙ্ক গদিও জানান, ওই এলাকার সাগরের নিচে স্রোতের প্রকৃতিও অনেকটা অচেনা। তীব্র স্রোতের জন্য উদ্ধার অভিযান চালানোও অনেক বেশি বিপজ্জনক।
রোমান বাহিনীর কাছে ধরা দেবেন না বলে আত্মহ্ত্যা করেছিলেন রানি ক্লিওপেট্রা। তাঁর স্মৃতি মেখে বসে থাকা ইতিহাসও বোধহয় পুরোটা ধরা দিতে চায় না আধুনিক মানুষের কাছে। তাই হয়তো রানি ক্লিওপেট্রার দেখানো পথ ধরেই রহস্যময় দূরত্ব বজায় রেখে সাগরতলায় ঘুমিয়ে আছে তাঁর প্রাসাদ।
বিবার্তা/জিয়া