ওষুধশিল্পে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নবদিগন্ত উম্মোচন করেছে। কারণ বাংলাদেশ এখন আর ওষুধ আমদানিকারক নয়, রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক ওষুধ কোম্পানি উন্নত দেশগুলোর সনদ লাভ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬০ দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। ধারণা করা হচ্ছে এই খাতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিগত চার দশকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২৫৭ কোম্পানির ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিদেশে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে একসময় বার্ষিক ৮০ শতাংশ ওষুধ বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হতো, সেখানে এখন আমদানি হয় মাত্র ৩ শতাংশ। এক সময় বিদেশি কোম্পানিগুলো এ দেশের ওষুধের বাজারের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। সেখানে এখন তারা নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৭ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২১ সাল নাগাদ ওষুধ রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় প্রায় একশ গুণ বেড়ে ৬০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওষুধ রপ্তানি বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের কয়েক ওষুধ কোম্পানি আমেরিকায় ওষুধ রপ্তানির শুরু করেছে। এই সুযোগকে ‘দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য খুব ইতিবাচক’ উল্লেখ করে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের রপ্তানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা করছেন তারা।
প্রতিবছরই রফতানির ও দেশের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে উৎপাদিত ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৬০ টি দেশে। বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতের সাথে নতুন করে ওষুধ রফতানির উদ্যোগ নিয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অধীনে থাকা ৪৩টি ওষুধের কাঁচামাল পেলে রপ্তানি আগামী চার বছরে ১০ গুণ বাড়বে। দেশীয় চাহিদার ৯৮ ভাগ ওষুধই এখন উৎপাদন হচ্ছে দেশে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ওষুধ রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ কোটি ডলারেরও বেশি। আশা করা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ ওষুধ রপ্তানি আয় সাড়ে ৮ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ওষুধ শিল্প সমিতি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অধীনে থাকা ৪৩টি ওষুধের কাঁচামালের সহজপ্রাপ্ততা হলে রফতানির পরিমাণ আগামী চার বছরে ১০ গুণ বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অনেক কোম্পানীই এখন আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সার্টিফিকেশন সনদও পেয়েছে বেশ কিছু কোম্পানি। এ কারণে ওই সব দেশসহ অন্যান্য দেশে ওষুধ রফতানি পর্যায়ক্রমে বাড়ছে।
তাদের মতে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ছাড়ের সুযোগ রয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও ওষুধশিল্প বিকাশে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। তারা জানান, বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা আর বিশ্ববাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ওষুধ রপ্তানিতে এশিয়ার শীর্ষে উঠে আসবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশীয় ৪৬টি ওষুধ কোম্পানি ওষুধ রফতানি করে এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। রফতানিতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড, নোভারটিস (বিডি) লিমিটেড, টেকনো ড্রাগস লিমিটেড, ইনসেপ্টা ফার্মা লিমিটেড, স্কয়ার ফার্ম লিমিটেড, দ্যা একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, এরিস্টোফার্মা লিমিটেড, রেনেটা লিমিটেড, এসকেএফ ফার্মা বাংলাদেশ লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, পপুলার ফার্মা, পপুলার ইনফিউসন, বায়ো ফার্মা, অপসোনিন, গ্লোব ফার্মা, বীকন ফার্মা, ড্রাগস ইন্টারন্যাশনাল, হেলথকেয়ার ফার্মা, ওরিয়ন ফার্মা, জেসন, নাভানা, জেনারেল, ডেলটা, গ্লাস্কো, ইবনেসিনা, রেডিয়ান্ট, নভো হেলথকেয়ার ফার্মাসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি।
ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান, মালয়শিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, মরক্কো, আলজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ছাড়ের প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সরকার দেশের ওষুধশিল্প বিকাশে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ওষুধ রপ্তানিতে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
বিবার্তা/জিয়া