অবশেষে বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রাণের দাবি দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্ক ট্রান্স এশিয়া রেলওয়ে (টিএআর) সঙ্গে যুক্ত হতেই এই রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে রেলপথটি নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে রেল বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুল প্রত্যাশিত এই রেলপথ নির্মাণ করা হলে পর্যটনশিল্পের বিকাশের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কও জোরদার হবে।
গত মঙ্গলবার রেলওয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইটে এই টেন্ডার আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমার শেষদিন নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২৮ নভেম্বর। অফিস খোলার দিন এই সময়ের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে হবে টেন্ডার নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানায়।
জানা গেছে, অগ্রাধিকার ও দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের ১০টি মেগা প্রকল্পের অন্যতম দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ। এই রেলপথটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা দিবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
এছাড়া বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় করা হবে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্প নির্মাণে আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ৬১৩ কোটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
রেলওয়ে সূত্রে জানায়, ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেয়া হয় এই রেলপথ নির্মাণে। চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনে প্রায় সোয়াশ বছর আগে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি মিয়ানমার। ১৮৯০ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-০৯ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে সমীক্ষাও চালায়। এরপর ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কাজও শুরু হয়।
তখন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাকি রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রেলপথ আর হয়নি।
এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার একবার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে এ পথে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উদ্যোগ নেয়া হয় প্রকল্পটি নির্মাণে। তৎকালীন সরকারের অনুরোধে ১৯৭৬-৭৭ সালে আবার সমীক্ষা করে জেআরটিএস।
পরে ১৯৯২ সালে এসকাপ কমিশন অধিবেশনে তিনটি ইউরো-এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এর একটি রুট বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর এই রুট নিয়ে আর তেমন আলোচনা করা হয়নি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে আবারও এ রেলপথটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
এরপর ২০১০ সালে এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকট গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়। প্রথমে মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তিতে প্রকল্পটি সংশোধন করে ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রুটটি ট্রান্স-এশিয়ান ও সাসেক রেল রুটভুক্ত হওয়ায় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ চালু করতে এ রেলপথটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তাই জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খরচ বিবেচনায় রেলপথটি নির্মাণে প্রায় প্রকল্পের ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৬৫ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুল হক বকশী বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম এই রেলপথটি আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্ক ট্রেন এশিয়া রেলওয়ে (টিএআর) একটি রুট। এই রেলপথটি নির্মাণ হলে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত সুবিধা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কথা রয়েছে। এছাড়া সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাহ, রামু, কক্সবাজার, উখিয়া ও গুনদুমসহ ১১টি রেলস্টেশন নির্মাণ এবং কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যালিং সিস্টেম, ৫২টি মেজর (বড়) ও ১৯০টি মাইনর (ছোট) রেল সেতু এবং ১১৮টি লেভেলক্রসিং ও ২টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে।
১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ১ হাজার ৭৪১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৬০ দশমিক ৩৬ একর এবং কক্সবাজার জেলায় এক হাজার ৫১ দশমিক ১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। এছাড়া রামু ও আশপাশের এলাকায় হাতির অভয়ারণ্য। ওই এলাকায় বুনোহাতি প্রায়শই দল বেঁধে চলাচল করে। এক্ষেত্রে রেলপথ যাতে হাতির চলাচলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে সেজন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হবে।
এজন্য রেলপথে বিশেষ ধরনের সেন্সর বসাতে হবে। এতে কখনো হাতি রেলপথে থাকলে ট্রেন চালক ওই এলাকা অতিক্রমের আগেই তা বুঝতে পারে। হাতির বিষয়টি মাথায় রেখে জমির প্রয়োজন কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
বিবার্তা/জিয়া