খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার বসে যশোরের রাজারহাটে। সপ্তাহে দু’দিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে চামড়ার হাট বসে। কোরবানি ঈদপরবর্তী সময়ে তাই এ বাজারের দিকে নজর থাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের।
শনিবার ছিল রাজারহাটে ঈদপরবর্তী প্রথম হাট। কিন্তু এবার হাটে প্রাণচাঞ্চল্য নেই বললেই চলে। চামড়া হাটে তুলে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। সবার চোখে মুখে যেন অন্ধকার। মুখ ভার হয়ে বসে আসেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। লোকসানে চামড়া বিক্রি করে তাদের মাথায় হাত উঠেছে।
রাজশাহীর বানেশ্বর এলাকা থেকে এক হাজার ৩শ’ পিস ছাগল ও ৭৫ পিস গরুর চামড়া নিয়ে যশোরের রাজারহাটে এসেছিলেন মোতালেব হোসেন। ছাগলের চামড়া ৯০ টাকা থেকে ১২০ টাকা এবং গরুর চামড়া কেনা ছিল তার এক হাজার ২শ’ থেকে এক হাজার ৫শ’ দরে। কিন্তু শনিবার তিনি হাটে দাম পেয়েছেন ছাগলের প্রতি চামড়া ৭৫ টাকা আর গরুর প্রতি পিস ৯শ’ টাকা করে।
তিনি জানান, রাজশাহী থেকে চামড়া পিকআপে করে ১৩ হাজার টাকা খরচ করে যশোরে এনেছিলাম লাভের আশায়। কিন্তু কেনার অর্ধেক দামও উঠছে না। তারপরও কিছু চামড়া বিক্রি করেছি ফিরে যাবার খরচ উঠানোর জন্য। বাকি চামড়া এলাকায় গিয়ে বিক্রি করব।
শুধু মোতালেব হোসেনই নয়, শনিবার রাজারহাটের সব খুচরা ব্যবসায়ী লোকসান গুনে চোখের পানি ফেলে চামড়া বিক্রি করে বাড়ি গেছেন।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ধল্লা নওয়াপাড়া থেকে ৫০টি গরুর ও ছাগলের ৬০টি চামড়া নিয়ে আসেন সার্থক মন্ডল। গরুর চামড়া গড়ে এক হাজার ৫শ’ টাকা এবং ছাগলের চামড়া কেনা ছিল তার একশ’ টাকা করে। কিন্তু এদিন গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন গড়ে এক হাজার ১২৫ টাকা ও ছাগলের চামড়া ৬০ টাকা করে।
তিনি বলেন, গতবার চামড়া বিক্রি করে কিছু লাভ হয়েছিল। এবার দেখছি পুঁজি বাঁচবে না। ক্রেতারা নিম্নমানের ছাগলের চামড়ার দাম বলছে ১০ টাকা পিস।
সদরের ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা দিলিপ বিশ্বাস বলেন, তিনি হাটে ১৫ পিস গরুর চামড়া এনেছিলেন। প্রতি পিস কেনা ছিল এক হাজার ২শ’ থেকে এক হাজার ৪শ’ টাকায়। অথচ পাইকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন প্রতি পিস এক হাজারেরও কম। ফলে তিনি চামড়া বিক্রি না করে ফিরে যাবেন।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল মজিদ পলাশ জানান, এবার ব্যবসায়ীদের হাতে কোনো টাকা নেই। সব পুঁজি আটকা পড়েছে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে ব্যবসায়ীদের বকেয়া রয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। গত বছরের পাওনার ২৫ ভাগ টাকা দিয়েছে ট্যানারি মালিকরা। এই টাকায় দেনা শোধ করবে, না নতুন করে চামড়া কিনবে।
তাছাড়া ট্যানারি মালিকরা দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কমে গেছে। তিনি জানান, পুঁজি সংকটের মধ্যেও লবণ সংকট চলছে। গতবছর লবনের বস্তা ছিল ৫৬০ টাকা। এবার বস্তা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬শ’ টাকায়। তরপরও লবণ পাওয়া যাচ্ছে না। লবণের অভাবে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
যশোর ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলো থেকে ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে হাজির হয় এই হাটে। রাজারহাটের এই চামড়াহাটকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান। দুই শতাধিক আড়ৎ রয়েছে এই মোকামে। প্রতি কুরবানির ঈদে রাজারহাটে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, সরকার চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি মালিকদের কোটি কোটি টাকা ঋণ দিলেও সেই টাকা তারা চামড়া খাতে ব্যয় না করে অন্য খাতে ব্যয় করেন। কুরবানির ঈদের সময় তাদের হাতে আর টাকা থাকে না, তখনই তারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দেন। এবারও তাই হয়েছে। টাকার অভাবে ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে পারছে না।
স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমেদ জানান, পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকটের সুযোগ নেবে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তারা বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। পরে বাজারে চাহিদামত দাম না পেয়ে তারা পাচারকারী চক্রের হাতে চামড়া তুলে দেয়।
রাজারহাটে চামড়া পাচার ঠেকাতে সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। সেখানে দায়িত্বরত উপপরিদর্শক সোহরাব হোসেন জানান, আমরা কঠোরভাবে নজরদারি করছি। কেউ চামড়া নিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া জাল টাকা শনাক্তে মেশিন দিয়ে টাকা চেক করা হচ্ছে।
রাজারহাটের ইজারাদার হাসানুজ্জামান হাসু জানান, প্রতিবছরই হাটের ইজারা দর বাড়ছে। অথচ চামড়া বিক্রি কমছে। এবারও হাটে তেমন চামড়া বিক্রি হবে না। ফলে আমদের লোকসান গুনতে হবে।
বিবার্তা/তুহিন/কাফী