সাধারণ কম্পিউটার প্রিন্টিংয়ের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে। এর সঙ্গে উচ্চতা যোগ করলেই তা হয়ে যায় ত্রিমাত্রিক বস্তু। থ্রিডি প্রিন্টার (ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ বা যুত উৎপাদন) এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে ডিজিটাল মডেল থেকে কার্যত যে কোন আকৃতির ত্রিমাত্রিক কঠিন বস্তু তৈরি করা যায়।
আমাদের চারপাশের জগত এই অগণিত ত্রিমাত্রিক বস্তু দিয়েই তৈরি। সুতরাং সাধারণ প্রিন্টারে যেমন নির্দেশ দিলেই দ্বিমাত্রিক যেকোনো বস্তু প্রিন্ট হয়ে যায়, তেমনি ত্রিমাত্রিক কিংবা থ্রি-ডাইমেনশনাল (থ্রিডি) প্রিন্টারে নির্দেশ দিলে আমাদের বাস্তব জগতের যেকোনো বস্তুর হুবহু আদল প্রিন্ট হয়ে যাওয়ার কথা। যার দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ, আছে, উচ্চতাও আছে।
থ্রিডি সিস্টেমস কর্পোরেশন’এর চার্লস ডব্লিউ হাল ১৯৮৪ সালে প্রথম কর্মোপযোগী থ্রিডি প্রির্ন্টার তৈরি করেছিলেন। চার্লস ডব্লিউ হাল আধুনিক থ্রিডি প্রিন্টারের আবিষ্কারক এবং এর কার্যক্ষম প্রমিত প্রযুক্তির উদ্ভাবক। প্রথম কোন প্রকাশিত তথ্যসূত্র অনুযায়ী, একটি কঠিন আকৃতি মুদ্রণের প্রথম কাজটি করা হয়েছিল ১৯৮১ সালে। এটি করেছিলেন নাগোয়া মিউনিসিপাল ইন্ড্রাস্ট্রয়িাল রিসোর্স ইন্সট্রটিউিটের হিদেও কোদামা। তবে সেসময় এর ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিল। চলতি শতাব্দীর শুরুতে অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই হঠাৎ এ প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার হয় এবং দাম কমার ফলে দ্রুত সাধারণ গ্রাহকের হাতের নাগালে আসে। যে প্রযুক্তি একসময় ব্যবহৃত হতো কেবল বড় বড় কারখানায় গাড়ি কিংবা মেশিনের মডেল তৈরিতে, তা দিয়ে কৌতূহলী কিশোর-কিশোরীরা ঘরে বসে জুতা, খেলনা, পুতুল, গয়না ইত্যাদি তৈরি শুরু করে।
তারপর থেকেই এই প্রযুক্তি বেশ উন্নতি লাভ করেছে। ৬০০ বছর আগে গুটেনবার্গ প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের পর থেকে এটাই খুব সম্ভবত প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় লক্ষণীয় উন্নতি। এটি এমন একটি যন্ত্র, যেটি সব ধরণের জিনিসের কপি করতে সক্ষম। কিন্তু এটা থ্রিডি প্রিন্টিং হলেও এটাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হবে সকলের কাছে। কিন্তু থ্রিডি প্রিন্টিং ইতিমধ্যেই অনেক কাজে ব্যবহার হচ্ছে, যেমন- শ্রবণযন্ত্র বানাতে, গয়না বানাতে, এমনকি নাসা’র প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করতে। এখন প্রযুক্তি সবার হাতের কাছে চলে এসেছে। তার মানে এখন নিজের গ্যারেজকে একটি ছোট কারখানায় পরিণত করে ফেলা সম্ভব খুব সহজেই।
থ্রিডি প্রিন্টারের কার্যপদ্ধতিও বেশ জটিল। এটি ত্রিমাত্রিক অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। এতে ব্যবহারকারী কম্পিউটারে সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোনো বস্তুর ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করেন। এরপর একে কয়েকটি স্তরে বিন্যস্ত করেন। প্রতিটি স্তর সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সফটওয়্যারে তথ্য প্রবেশ করান। প্রিন্টার এ তথ্য পুনরায় বিশ্লেষণ ব্যবহারকারীর নির্দেশিত পথে একের পর এক স্তর তৈরি করে। এভাবে সবগুলো স্তর সম্পন্ন হলে তৈরি হয় কাঙ্খিত বস্তু। ব্যাপারটা অনেকটা ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি বানানোর মতোই।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন- নাক, কান, আঙ্গুল ইত্যাদি তৈরিতে করে প্রতিস্থাপণ করা যায়। এই প্রক্রিয়া কাগজের উপর কালি দিয়ে প্রিন্ট করার মতই সহজ। এক্ষেত্রে কাগজ ও কালির পরিবর্তে সেলের মাধ্যমে টিস্যু তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় শরীরের কোনো অঙ্গ স্ক্যান করে সেটা থ্রিডি প্রিন্টারে ইনপুট করলে তা থেকে থ্রিডি আউটপুট পাওয়া যায়। এরকম একটি অঙ্গ তৈরি করতে প্রিন্টারের ৪-৬ ঘন্টা সময় লাগে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কিডনি তৈরি করা যায়, কিন্তু তা এখনও প্রতিস্থাপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এটা নিয়েও পরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষাটি নর্থ ক্যারোলিনার ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটি’র ডক্টর অ্যান্থনি আট্টালা পরিচালনা করছেন। শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরির এই প্রক্রিয়াটিকে বলে ‘বায়ো-প্রিন্ট’। প্রথমে এই প্রযুক্তিটি শুধুমাত্র মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধে আহত সৈনিকদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রতিস্থাপণ করে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হত।
থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিটি কিন্তু নতুন নয়। সেই আশির দশক থেকেই বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে এটি উন্নত হতে হতে এই পর্যায়ে এসেছে।
এই প্রিন্টার সাধারণত ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক মুদ্রণের কাজ করে। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এই মেশিনের বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়েছে, পাশাপাশি মেশিনগুলোর দামও অনেকটা কমেছে। থ্রিডি প্রিন্টার প্রিন্টিং খাতে বিষ্ময়কর বদল এনেছে৷ কারো বিশ্বাসই হবে না এই প্রিন্টার দিয়ে কত কী তৈরি করা যায়৷
বিবার্তা/উজ্জ্বল/প্লাবন