বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না বিএনপি। কারণ বারবার ঘোষণা দিয়েও কোন আন্দোলন সফল করতে পারেনি দলটি। কাউন্সিলের ছয় মাস পার হলেও গঠিত হয়নি দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। দলীয় কর্মসূচিতে নেই কোন অগ্রগতি।
রাজনীতির এই করুণ বাস্তবতায় বিএনপিতে হতাশা বিরাজ করছে।দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এবং দলের গত কয়েক মাসের সাংগঠনিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন বিএনপির কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকায় দলের সর্বস্তরে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থতার পর দীর্ঘদিন কোন আন্দোলন কর্মসূচি নেই বিএনপির। এছাড়া দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন, দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলা-হামলা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
তাই একদিকে যেমন বাড়ছে ক্ষোভহাতাশা, অন্যদিকে দলে নেমে এসেছে সাংগঠনিক স্থবিরতা। একাধিকবার উপজেলা-জেলা কমিটি পুনর্গঠনের টার্গেট নির্ধারণ করলেও তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি দলটি। জাতীয় সম্মেলনের পর প্রায় ৬ মাস কেটে যাচ্ছে কিন্তু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। কমিটির বেশিরভাগ পদে নেতাদের নাম ঘোষণা করা হলেও তা নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কোন্দল চলছে। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে বলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের আশঙ্কা।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, সব বাধা উপেক্ষা করে এবার দলকে ঠিকমতো পুনর্গঠন করা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে চরম মূল্য দিতে হবে। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এবং দলের গত কয়েক মাসের সাংগঠনিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এসব তথ্য মিলেছে।
দলের নেতারা বলছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনা কেবল সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমেই সম্ভব। এছাড়া সরকার বেশিদিন স্থায়ী হলে নেতাকর্মীরা আরও মামলা-হামলার শিকার হতে পারেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে বিএনপি। এ লক্ষ্যে টানা হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি দেয় বিএনপি। আন্দোলন চলাকালে নিহত হয় দেড় শতাধিক। এ সময় বাইরের দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে চালানো হয় নানা প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের সমর্থন পেলেও দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয় বিএনপি।
এছাড়া জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটে রাখা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সংকটে পড়ে বিএনপি। জামায়াত সঙ্গে থাকায় খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীরা জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করলেও সে বিষয়ে কর্ণপাত করেননি তিনি। আর দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দণ্ডিত হওয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়েছে দলটি।
তারেক রহমান দেশে ফিরে আপিল না করলে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এতে দলের অনেক নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এছাড়া টানা হরতাল-অবরোধসহ কয়েক দফা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন নাশকতার মামলায় তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে দলের তৃণমূলে।
অভিযোগ রয়েছে, গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে দলের বিভিন্ন কমিটিতে একাধিক পদে বহাল রয়েছেন বিএনপির শতাধিক নেতা। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও বাদ যাচ্ছেন না এ অভিযোগ থেকে। তারা মানছেন না চেয়ারপারসন ও মহাসচিবের নির্দেশও। গঠনতন্ত্রে এক নেতার এক পদ নীতি গ্রহণ করার পরও এই নেতারা নানান অজুহাতে এখনও আঁকড়ে রেখেছেন একাধিক পদ।
গত বছরের মে মাসে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। কেন্দ্র থেকে এজন্য দুই মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দলের জাতীয় কাউন্সিলসহ বেশ কিছু কারণে সেই প্রক্রিয়া থেমে যায়। দেশের ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৫টির মতো জেলায় নতুন কমিটি দিতে পেরেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
জানা গেছে, আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি আড়াই বছরেও। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনও মেয়াদোত্তীর্ণ। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতাকর্মীরা আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও হামলা-মামলাসহ সাংগঠনিক দুর্বলতায় তারা এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় দলকে সম্পূর্ণরূপে গতিশীল না করে আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে দল পুনর্গঠনের এমন ধীরগতি এবং দীর্ঘদিন কোন কর্মসূচি না থাকায় তৃণমূলসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে নেমে আসছে হতাশা ও ক্ষোভ। শেষ পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে দলের পুনর্গঠন হবে কিনা এ নিয়ে তাদের অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, সুবিধাবাদী, নিষ্ক্রিয় ও অযোগ্যদের বাদ দিয়ে সৎ ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের যে দাবি উঠেছে, তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বিবার্তা/জিয়া