শিবু হালদার। ৩০ বছর কেটেছে তার পানিতে। খালে-নদীতে মাছ ধরতেন, বাজারে বিক্রি করতেন। ভালোই কাটতো তার দিন। কিন্তু শিবু হালদার এখন ভালো নেই। তার হাতে জাল নেই। ১০ বছর আগেই পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। এখন তিনি ডাব ব্যবসায়ী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ডাব কেনেন। তারপর বাজারে বেচেন। কোনো দিন বিক্রি হয়, আবার কোনো দিন হয় না। ফলে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে।
পেশায় পরিবর্তন কেন, জানতে চাইলে পঞ্চাশোর্ধ শিবু বলেন, ‘সে কথা আর বলবেন না বাপু। এই দুই খাড়ির পানি নাইম্যা নদীর মাছ শ্যাষ। খাড়ির নষ্ট (দূষিত) পানিতে মাছ তো নাই-ই, খাড়ির পানি নদীতে মিশলেই দু’দিনে সব মাছ মর্যার সাবাড়। কী করবো? কিছু তো করতে হবে! ডাব বেচি।’
শিবুর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার মহানন্দখালির উত্তরপাড়া গ্রামে। শিবু বলছিলেন তার গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত বারনই নদীর কথা। এক সময় এ নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। পবার কয়েকটি গ্রামের শ’দুয়েক জেলে পরিবার এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বছর দশেক আগে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত দুটি খালের সঙ্গে রাজশাহী শহরের দুটি নালা যুক্ত করে দেয়া হয়। এতে শহরের কলকারখানা, হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক ও বাসাবাড়ির দূষিত পানি ও বর্জ্য নালা, খাল হয়ে নদীতে গিয়ে মেশে। আর এতেই কপাল পোড়ে জেলেদের। এখন খালে, নদীতে- কোথাও মিলছে না মাছ।
রাজশাহী শহরের একটি নালা গিয়ে মিশেছে পবা উপজেলার মহানন্দখালি খালে। খালটি পবার হালদারপাড়া এলাকায় বারনই নদীর সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। অন্যদিকে রাজশাহী মহানগরীর নতুন বিলশিমলা, সিটিহাট হয়ে আরেকটি নালা দুয়ারি খালে গিয়ে মিশেছে। পবার দুয়ারি এলাকায় এ খালটিও বারনইয়ে গিয়ে মিশেছে। তবে নদী ও খালের সংযোগস্থলে বসানো হয়েছে দুটি স্লুইসগেট।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, খাল দুটির পানি এতই দূষিত, সেখানে একটি মাছও বাঁচতে পারে না। এরপরেও বর্ষায় খালে পানির চাপ বেড়ে গেলে স্লুইসগেট খুলে দেয়া হয়। তখন খালের পানি নদীতে নামলে মাছ মরে ভেসে ভেসে ওঠে।
মহানন্দখালি খালের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে হালদারপাড়া গ্রাম। এ গ্রামে প্রায় ৬৫টি জেলে পরিবারের বসবাস। গ্রামের বাসিন্দা প্রফুল্ল হালদার বলছিলেন, এক সময় এ দুটি খাল ও বারনই নদীতে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। তাদের জীবিকা নির্বাহে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন খালের দূষিত পানিতে একটি মাছও নেই। এখন শুধু নদীটাতেই সামান্য পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু খালের স্লুইসগেট খুলে দিলে নদীতেও মাছ পাওয়া যায় না। এতে মানবেতর জীবনযাপন করেন জেলেরা। বাধ্য হয়ে তারা পেশা পরিবর্তন করছেন।
শাকিম দুয়ারি গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাক জানান, গ্রীস্মকালে খাল দুটিতে পানি কমে আসে। প্রখর রোদে তখন দূষিত পানিতে উৎকট গন্ধের সৃষ্টি হয়। এতে খালের পাশের বাসিন্দাদের টেকাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
মহানন্দখালি স্লুইসগেট এলাকার জুলমত আলী জানান, সারাবছরের জন্যই খাল দুটির পানি বাসাবাড়িতে ব্যবহারের অনুপযোগী। এ পানিতে কেউ গোসলও করেন না। তবে এ পানি ব্যবহার করলে ভালো ফসল ফলে। তাই কৃষকরা তাদের জামিতে খালের পানি দিয়ে সেচ দেন। তবে পানির ছোঁয়া পাওয়ায় তাদের শরীরে খোসপঁচড়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়।
শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নালার পানি মিশে খাল দুটির পানির রঙ বদলে কালো হয়ে গেছে। সিটিহাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল এলাকার বড় নালাটি এই এলাকা দিয়ে দুয়ারি খালে গিয়ে মিশেছে। নালার বিবর্ণ পানিতে চোখে পড়ে গজ, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ও ওষুধের বোতলসহ নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য পদার্থগুলো আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেগুলো নালায় গিয়ে মেশার কথা নয়। তবে হাসপাতালের ভেতর থেকে পানি নালায় যায়। সেগুলো কোন দিকে নিয়ে যাবে, তার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. রেদওয়ানুর রহমান জানান, শহরের দূষিত পানি ও বর্জ্য খাল দুটিতে মিশে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। জীববৈচিত্র্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভেঙে পড়েছে খালে খাদ্যশৃঙ্খল। এ ব্যাপারে এখনই প্রশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী অফিসের উপ-পরিচালক নূর আলম বলেন, মহানন্দখালি ও দুয়ারি খালের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সেখানে শহরের বিষাক্ত পানি না পাঠানোর জন্য সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি, চিঠির জবাবও দেয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
পবা উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সেলিম হোসেনও জানিয়েছেন খাল দুটিতে নালার সংযোগ বন্ধ করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ ব্যাপারে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা জেবুন্নেশা বলেন, নালা দুটি গতিপথ পরিবর্তন করে দূষিত পানি অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। শহরের কাছে পদ্মা নদীতে এসব পানি ফেলা যায়। তবে এমনটি করলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। তাই বাধ্য হয়েই শহরের বর্জ্য-পানি বারনাইয়ের দিকে পাঠানো হচ্ছে।
তিনি জানান, নালা দুটির প্রথম অংশে দুটি পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট বসানো গেলে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু প্ল্যান্ট বসাতে যে অর্থের প্রয়োজন তা সিটি কর্পোরেশনের নেই। তারাও সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিদেশী কোনো দাতা সংস্থাকে দিয়ে প্লান্ট বসানোর জন্যও তারা চেষ্টা করছেন।
বিবার্তা/রিমন/জিয়া