দীর্ঘ ৫ বছর দেড় ঘন্টা পায়ে হেটে স্কুল করেছেন। ২০১৫ সালেও যে গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। কলেজে পড়াকালে ধানক্ষেতে দিন মজুরের কাজও করেছেন। কোনোদিন কোচিং সেন্টারের বারান্দায় যাননি। তিনি এখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একই সঙ্গে বিজয় একাত্তর হলের হাউজ টিউটর। নাম জাহিদুল ইসলাম সানা। বাবা ছোটখাট ব্যবসা করেন। মা গৃহিনী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন একটা নেই। সেই মায়ের হাতেই লেখা পড়া শুরু করেন এই সানা। শিক্ষা জীবনে কোনো ক্লাশে দ্বিতীয় হননি তিনি। আজ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছেন।
বুধবার সন্ধ্যায় এসেছিলেন বিবার্তা২৪.নেট অফিসে। চিফ রিপোর্টার মহসিন হোসেনকে শোনালেন তার সুখ দু:খের সব কাহিনী। আজ পাঠকদের সেই গল্পই শোনাবো।
আপনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন এবং বলছিলেন যে এটাই আপনার স্বপ্ন ছিল, যা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আপনি কী মনে করেন, এটাই দেশের সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ পেশা? জবাবে জাহিদুল ইসলাম সানা অত্যান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, অবশ্যই তাই মনে করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেই একজন শিক্ষার্থী নিজেকে ধন্য মনে করেন। এর বড় কারণও আছে। এটাই দেশের সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সুতরাং এখানে যারা ভর্তি হয় তারা সবাই মনে মনে চিন্তা করে যাতে এখান থেকে ভাল রেজাল্ট করে শিক্ষকতা করতে পারেন। তবে সবার পক্ষেতো আর সেটা সম্ভব হয় না।
আমি অনেক কষ্ট করে লেখা পড়া শিখেছি। ছাত্রজীবনে লেখা পড়াটাই ছিল আমার নেশা। আমি মনে মনে যে আশা করেছিলাম। আজ আমার সে আশা পূরণ হয়েছে। এ জন্য সবার আগে আমার মাকে ধন্যবাদ দেব। যার স্নেহ আর ভালবাসাই ছিল আমার শিক্ষার প্রেরণা।
আপনি বললেন, সবার আগে আপনার মাকে ধন্যবাদ দেবেন। তো সেই মায়ের কথা কিছু বলেন। এসময় জাহিদুল ইসলাম সানা, আমার মা খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন গৃহিনী। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন পাননি। কিন্তু তার বাস্তব জ্ঞান অত্যান্ত বেশি। আমার লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়েছে এই মায়ের কাছ থেকেই। আমার মা’র এখন বয়স হয়েছে। এখনো তিনি পত্রিকা পড়েন। বই পড়েন। তার কাছ থেকেই লেখা পড়ার উৎসাহ পেয়েছি।
জাহিদুল ইসলাম যতক্ষণ গল্প করেছেন তার মধ্যে কিছুক্ষণ পর পরই তার মায়ের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, একবার তিনি যখন আলিম পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেসময় তার টাইফয়েড হয়েছিল। এতে এক মাসের মতো বিছানায় ছিলেন। তখন প্রতিদিন রাতে তার মা পাশে বসে থাকতেন। এতে মায়ের কষ্ট দেখে অসুস্থতার মধ্যে তার আরো কষ্ট হতো।
অপরদিকে একবার তার মাও ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার কোনো বোন নেই। বাড়িতে অন্য কেউ ছিল না। এসময় তিনি বাড়ির রান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করতেন। একই সঙ্গে মায়ের সেবাও করতেন। তো এ অবস্থায় একদিন তার মা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সানা তাকে ধরে তুলতে গেলে মা তার গায়ে বমি করে দেন। তার পুরো শরীরে বমি লাগলেও তিনি মাকে ছেড়ে দেননি। এই কথাটি সব সময়ই তার মনে পরে।
খুলনা জেলা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলা। প্রত্যন্ত গ্রাম। সেখানে ফতেকাঠি নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন জাহিদুল ইসলাম সানা। তিনি বলেন, তৃতীয় শেণি থেকে একাদশ (আলিম) শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ক্লাশে দ্বিতীয় হননি। সব সময় প্রথম হয়েছেন। ২০০৪ সালে ৪.৭৫ পেয়ে দাখিল (এসএসসি) পাশের পর কুশাডাঙ্গা আলহাজ কমর উদ্দিন আলিম মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
সে সময় তিনি একজন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। তার বাড়ি ছিল সানার বাড়ি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই ঘন্টা পায়ে হেটে সেই স্যারের বাড়ি যেতেন প্রাইভেট পড়তে। সকালে প্রাইভেট শেষ করে যেতেন মাদ্রাসায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। এভাবে তিনি এক টানা ৫ বছর পায়ে হেটে মাদ্রাসায় যেতেন ও প্রাইভেট পড়তেন। তাদের ওই অঞ্চলে তখন রাস্তাঘাট ছিল না। পায়ে হাটাই ছিল একমাত্র উপায়।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি যখন আলিম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, আমি ধান ক্ষেতে দৈনিক ত্রিশ টাকা মজুরিতে কাজও করেছি। মাদ্রাসা যখন ছুটি থাকতো তখনই মাঠে কাজ করতে যেতাম।
আলিম পরীক্ষার আগে এক নাগারে ৬ মাস বিছানায় পিঠ দেননি তিনি। চেয়ারে বসে পড়েছেন, চেয়ারেই ঘুমিয়েছেন। কয়রা উপজেলায় ২০০৬ সালে সকল স্কুল কলেজের মধ্যে একজন মাত্র এ প্লাস পান যিনি জাহিদুল ইসলাম সানা।
এতে তিনি উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনেক পুরস্কার পান। আলিম পাশ করার পর একমাস অসুস্থ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে পারেননি। এমন অবস্থায় তিনি ঢাকায় এলেন। হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ৬ এর (ক) চাচা হাফিজুর রহমানের রুমে ওঠেন। এই পরীক্ষার আগে ৯দিন খুলনায় পজিট্রন নামে কোচিং সেন্টারে পড়েছিলেন। আর কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এভাবেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে ১১৫৮ সিরিয়ালে সুযোগ পান। ইসলামিক শিক্ষা বিভাগে। মহসিন হলেই সিট পান তিনি।
বাড়ির আর্থিক অবস্থাতো ভাল না। তো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়ার খরচ কিভাবে চালাতেন? জাহিদুল ইসলাম সানা বললেন, আমার বড় ভাই আফজাল হোসেন তখন খুলনায় একটা এনজিওতে চাকরি করতেন। তিনি প্রথম একবছর প্রতিমাসে আমাকে ১ হাজার ৮০০ করে টাকা দিতেন। এতেই আমার খরচ হয়ে যেত। তখন সব কিছুর দাম কম ছিল। এরপর আমার মা একটা গাভী বিক্রি করে ২২ হাজার টাকা আমাকে দিলেন। সেটা একটা ব্যবসায় খাটিয়ে আমার লেখা পড়ার খরচ চালাতাম। এরপর লেখা পড়ার পাশাপাশি ছোটখাট ব্যবসা করে খরচ চালিয়েছি।
২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিভাগে ব্যাচে দ্বিতীয় হন জাহিদুল ইসলাম সানা। এতে এওয়ার্ড অব ডিনস্ পান তিনি। ওই বছরের ২৪ এপ্রিল তাকে এওয়ার্ড দেয়া হয়।
মাস্টার্স শেষ করার পরই অনেকগুলো চাকরি হয়ে যায় তার। কিন্তু জয়েন করেননি। এর মধ্যে ধানমন্ডি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ও জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারের চাকরি হলেও তিনি জয়েন করেননি।
৩৪তম বিসিএসে তিনি সফলতা পান। তার বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হোক। কিন্তু তিনি বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেননি।
তার ইচ্ছা একটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। শেষ পর্যন্ত হলেনও তাই। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর জয়েন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আপনিতো জীবনে অনেক কষ্ট করে এই সফলতা পেলেন। তো বর্তমানে আপনার যারা ছাত্র তাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন কি?
জাহিদুল ইসলাম সানা বলেন, ছাত্রজীবনে আমিও প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু কখনো পড়ালেখায় ফাঁকি দেই নি। আজকের ছাত্ররাই আমাদের প্রাণ। ছাত্রদের নিয়েই আমাদের সবকিছু।
তাদেরকেও বলবো। তারা যেন শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এটি। এই সময়কে যারা গুরুত্ব না দেবে তাদের পরবর্তী সময়ে দু:খ কষ্ট ছাড়া আর উপায় থাকে না। তাই শিক্ষার্থীদের একটাই পন হওয়া উচিত, তা হলো শিক্ষা, শিক্ষা আর শিক্ষা।
আপনার পরিবারের অন্য সদস্যরা কে কী করেন? তিনি বলেন, আমার পিতা আরশাদ আলী সানা ব্যবসা করেন। মা সালেহা বেগম গৃহিনী। বড় ভাই আফজাল হোসেন চাকরি করেন। আমি মেঝ। তৃতীয় ভাই ব্যবসা করে। ছোট ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ছে।
গল্পতো অনেক হলো। তবুও শেষ হলো না। হ্যাঁ গল্প কখনো শেষ হয় না। গল্প যেখানে শেষ সেখানেই শুরু। আজ আর নয়। আর একদিন শোনা যাবে।
বিবার্তা/মহসিন