সাদিক ইভান। শিশু সাংবাদিকতায় সমাদৃত একটি নাম। স্কুলজীবন থেকেই গণমাধ্যমে যার সম্পৃক্ততা। ইভান এখনো উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয়নি। পড়াশোনা করছেন বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকায়। এরই মধ্যে তার ঝুলিতে জমেছে বহু অর্জন। টানা তিনবার তিনি পেয়েছেন ‘ওয়ার্ল্ড লিটারেচার সেন্টার’ পুরস্কার।
আইসিটি মন্ত্রণালয় তাকে দিয়েছে একটা ল্যাপটপ। পেয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের আরো নানা পুরস্কার। স্বল্প সময়েই তিনি করেছেন এতো সব অর্জন। তার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। আর তাই তো পড়াশুনার ফাঁকে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিভা বিকাশের সংগ্রাম। বর্তমানে তিনি বিডিনিউজ২৪ডটকমের রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তরুণ এ সম্ভাবনাময় সাংবাদিক সম্প্রতি মুখোমুখি হন বিবার্তার। জানালেন নিজের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প। সেই গল্প জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
আইনজীবী বাবার একমাত্র ছেলে ইভান। জন্ম ঢাকায় হলেও শৈশব কেটেছে গাজীপুরে। গ্রামের নিবিড় প্রকৃতির ছন্দময়তায় বড় হতে থাকেন তিনি। যৌথ পরিবারে অনেক ভাইবোন আর পারিবারিক বন্ধনে শৈশব কেটেছে তার। পরিবারের প্রত্যেকেই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কাজ করেন। এর মাঝে ইভানের মিডিয়াতে পা রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। অসম্মত ছিলো সবাই।
ইভান তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। হঠাৎ বই পড়ার তীব্র ইচ্ছে তাকে ভর করে। লেখালেখির শুরুটাও ঠিক এরপর থেকেই। তবে গণ্ডিটা কেবল নিজ ডায়রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এভাবেই চলতে থাকে। তারপর লেখা পাঠাতে থাকেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। কয়েক বছর পর তিনি সদস্য হন দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরের।এসএসসি পরীক্ষার পর আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ইউনিসেফ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা শিশু সাংবাদিকতায় বিশ্বে প্রথম বাংলা সাইট ‘হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে’।
এ বিষয়ে ইভান বলেন, একদিন দেখি বিডিনিউজে বলা হচ্ছে শিশু সাংবাদিক হতে চাও তাহলে ক্লিক করো। সেখানে দেখি লেখা রয়েছে, হ্যালোতে আবারো শুরু হয়েছে নিবন্ধন। আমি বেশ উৎসাহী হয়ে কাউকে না জানিয়েই নিবন্ধন করি। সিভি এড করি। তারপর একটি রিপোর্ট করতে বলা হয়। ভেবেই পাচ্ছিলাম না কি রিপোর্ট করবো। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি বাদ পড়ে যাই! ভাবছিলাম আমাকে একটি ভালো রিপোর্ট করে মন জয় করে নিতেই হবে। সাহায্য নেয়ার মত আশপাশে কাউকেই পাচ্ছিলাম না। নিয়মিত পত্রিকা পড়তে থাকি। খুঁজতে থাকি রিপোর্টের বিষয়বস্তু। চিন্তাভাবনা করে একটি আইডিয়া খুঁজে পাই।
ইভান বলেন, রিপোর্টটি এরকম ছিলো, একটি সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ গজ দূরেই রেলক্রসিং। কিন্তু এখানে নেই অনুমোদিত রেল গেইট। শিক্ষার্থীরা বেশ আতংকে পারাপার হয়। গত বছর এখানেই কাটা পড়ে অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী মুন্নী আক্তার। সরকার পরিবর্তন হলেও বিষয়টি কোনো প্রতিনিধিরই নজরেই আসছে না। ইস্যুটি এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিপোর্টটি জমা দিয়ে যখন নিয়োগ প্রক্রিয়া সব সম্পন্ন হলো তখনো বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমাকে সিলেক্ট করবে। কাজ শুরুর কিছুদিন পরই আমার জীবনের প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম সেদিন। আরো ভালো লাগতো যখন অফিস থেকে নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ করা হতো।
শিশু সাংবাদিক হিসেবে প্রথম রিপোর্ট করার অভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি বলেন, একটি রিপোর্টের প্রয়োজনে অফিস থেকে বলা হলো শিক্ষা অফিসে যেতে। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম আমি কি পারবো? শিক্ষা অফিসারের সাথে কিভাবে কথা বলবো? অফিস থেকে সব নির্দেশনা মেনে সাহস নিয়েই গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর শিক্ষা অফিসার দুইবার বললেন, তুমি বিডিনিউজে কাজ করো? সত্যি কি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম? তারপর আইডি কার্ড দেখালাম। উনি চমকে গেলেন। আমার ফোন নম্বর রাখলেন, উনার ফোন নম্বর দিলেন। সেদিন আঁচ করতে পারছিলাম আমি কত বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি।
সাংবাদিকতা জীবনের মজার স্মৃতির কথা জানতে চাইলে ইভান বলেন, আমার সাংবাদিকতা জীবনের একটা আনন্দময় স্মৃতি আছে যা আজও আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সেটা হলো- কাজে যোগ দেয়ার অনেকদিন পর আমাকে আইডি কার্ড দেয়া হয়েছিলো। সেদিনকার অনুভূতি ছিলো সবচেয়ে মজার। আইডি কার্ড পাওয়ার পরদিনই একটি ফিল্ডওয়ার্কে যাই। প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিলো। উত্তেজনার কারণে সেদিনই বেরিয়ে যাই। কষ্ট শেষে বেশ ভালো লাগছিলো যখন রিপোর্টটি ছাপা হলো। টেনে টেনে জোর করে সবাইকে রিপোর্ট দেখিয়েছি। ফোন করেছি। তখন ছিলাম গাজীপুর প্রতিনিধি। এরপর কিছু সময়ের মধ্যেই ঢাকার প্রতিনিধি হই। যখন প্রথমদিন অফিসে গেলাম, আমাদের মিটিং হলো তখন বিষয়গুলো আরো ভালো লাগছিলো। এবার আমার আরেকটা পরিবার হলো। এই পরিবারের অনেক সদস্য আছে।
ইভান বলেন, এখানে একাধিক কর্মশালা, প্রশিক্ষণ হয়েছে আমাদের। বিডিনিউজের সিনিয়র রিপোর্টারদের কাছ থেকে এভাবে হাতেকলমে সাংবাদিকতা শিখতে পারবো কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। এখনো একটু একটু করে শিখে যাচ্ছি প্রতিদিন। নানা অজানা জিনিসগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখি। মাসিক মিটিংয়ে বড় ভাইয়াদের কাছে সেগুলো জেনে নেই। উনারা ক্লাস নেন, রুলস দিয়ে শেখান, আমাদের প্রশ্নের জবাব দেন।
সাংবাদিক জীবনের প্রাপ্তি বিষয়ে ইভান বলেন, আমার রিপোর্ট দেখে অনেকে ফোন দেয়, ফেসবুকে যোগাযোগ করে। গত বছর একটি কল পেয়েছিলাম তা খুব মজার ছিলো। এআর গ্রুপের সিইও আমার সাথে যোগাযোগ করে রিপোর্টের বেশ প্রশংসা করেন। তিনি আমার নাম লিখে ফেসবুকে সার্চ করে বহু কষ্টে নাকি খুঁজে পেয়েছেন। তারপর ফেসবুকে আমার ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করেন। দাওয়াত করেন ওনার অফিসে।
ইভান বলেন, শখের বশে সাংবাদিকতা করি। এর মাধ্যমেই আমি উপকার করতে পেরেছি মানুষের। আমার রিপোর্টের পর চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। একটি সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে ঔষধ দেয়ার কথা ছিলো। সেখানে ঔষধ বিক্রি করা হতো সেটিও বন্ধ হয়েছে আমার রিপোর্টের পর। এরকম আরো একাধিক অনিয়ম বন্ধ করতে পেরেছি। মানুষের জন্য কিছু করতে আমার প্রচণ্ড ভালো লাগে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সেটি করতে পারছি বলে সাংবাদিকতায় বেশ আকৃষ্ট আমি।
এর মধ্যেই আরো তিনটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে কাজ করলেও ইভান তাতে স্থায়ী হননি। একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে নিয়োগ পেয়েও পারিবারিক অসম্মতির ফলে পিছপা হন তিনি। এশিয়ান রেডিও ৯০.৮ এফএম এ হয়েছে তার রেডিও সাংবাদিকতার সূচনা। আজিজুল বশির রাতুলের প্রযোজনায় ‘আমরা সবাই রাজা’ নামের একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার প্রস্তুতি চলছে তার। এশিয়ান রেডিওর সিসিও মোহাম্মদ শেখ কাদিরের অসীম ভালবাসা ও স্নেহের ফলেই নাকি তার রেডিওতে পদচারণা, বলেন ইভান।
ইভানের বর্তমান ব্যস্ততা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর আর পড়াশোনাকে ঘিরে। দায়িত্বের সাথে ছুটে চলছেন রাষ্ট্র প্রতিনিধি থেকে শুরু করে খ্যাতিমান, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের কাছে। লক্ষ্য একটাই : শিশুদের ব্যাপারে তাদের সজাগ রাখা।
ইতিমধ্যেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া, শিশুসাহিত্যিক আনজীর লিটন, কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব, এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত, এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ.ই.মামুন, চ্যানেল আইয়ের নির্বাহী পরিচালক ইসরারুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমানসহ অসংখ্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়েছেন ইভান। এরই প্রেক্ষিতে গত বছর ‘এআর মিডিয়া গ্রুপ’ইভানকে একটি সংর্বধনা দেয়। ক্লোজআপ ওয়ান তারকা মেহরাব এসময় উপস্থিত ছিলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী সম্প্রতি এক টু্ইট বার্তায় ইভানকে তাঁর শিশু সহকর্মী বলে পরিচয় করিয়েছেন। ইভান বলেন, সংক্ষিপ্ত সাংবাদিকতার জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি আমি। পেয়েছি বড় বড় মানুষের আদর আর ভালোবাসা। সাংবাদিকতা না করলে হয়তো তাদের সাথে আমার পরিচয়টাও হতো না। তবে শুধু সাংবাদিকতা নয়, জীবনের প্রতিটি কাজকেই আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করি। স্কুলে যতবার ‘এইম ইন লাইফ’রচনা লিখেছি ততবার নিজের জীবনের লক্ষ্য লিখেছি ‘চ্যালেঞ্জ’।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/মৌসুমী