গজদাঁতওয়ালা মুখে অসম্ভব প্রাণখোলা হাসি সবসময় লেগেই থাকে তার। লম্বা ছিপছিপে গড়নের এই মানুষটিকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, ছোটোবেলায় ইনিই ছিলেন দুষ্টের শিরোমণি। কৈশোর কেটেছে সারদিন ঘুরে বেড়িয়ে, দুষ্টুমি করে, একদম কারো কথা গায় না মেখে এবং অনেক অনেক বকা খেয়ে। দুষ্টুর এই রাজার নাম অসীম চন্দ্র রায়। শিল্পের অঙ্গনে অবশ্য তিনি কার্টুনিস্ট অসীম চন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিত।
গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা সরকারী চাকুরীজীবী হওয়ায় যখন অসীমের বয়স ৫/৬, তখন তারা পঞ্চগড় চলে যান। সেখানেই একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে। মায়ের ছিল আঁকাআঁকির ঝোঁক। তাই তিনি ড্রয়িং শিখতে ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন শিশু একাডেমিতে । কিন্তু সেখানে ২-৩ মাসের বেশি টিকতে পারলেন না অসীম, তবে আঁকাআঁকিটা ছাড়লেন না। ১৯৯৯ সাল থেকেই জেলা ও অঞ্চল পর্যায়ের অনেক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করেন এবং অনেক পুরস্কারও পান।
১৯৯৯ সাল। হুট করেই বাবা চাকুরী ছেড়ে দিলেন। অস্বচ্ছলতা গ্রাস করল পুরো পরিবারকে। তখন পরিবারের খরচ চলতো বাবার জমি বিক্রির টাকায়। এভাবে আর কতদিন ? একসময় ফুরিয়ে এলো বিক্রিযোগ্য জমি। মা ধার-দেনা করে অনেক কষ্টে পরিবার সামলাতেন। অস্বচ্ছলতার সাথে অনেক সংগ্রাম করে্ উচ্চ-মাধ্যমিকটা দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু চান্স হলো না। তারপরও হাল ছাড়লেন না। আই সি সি আর এ স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করলেন। শিক্ষাবৃত্তিটা পেয়েও গেলেন। বর্তমানে তিনি পড়াশুনা করছেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপিঠ কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজ্যুয়াল আর্ট বিভাগে, শতভাগ শিক্ষাবৃত্তি নিয়েই।
অসীমের মায়ের ইচ্ছাতেই তাই আঁকাআকির হাতে খড়ি হলেও মা কখনো চাননি ছেলে আর্ট নিয়ে পড়াশুনা করুক। মা-বাবার ইচ্ছে ছিল অসীম বড় হয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে।
ক্যারিকেচারে পারদর্শী এই শিল্পী শুরুর কথা জানালেন এভাবেই - ‘ পঞ্চগড়ে যখন ছিলাম তখন এমন কেউ ছিল না যে আমাকে ফাইন আর্ট সম্পর্কে ধারণা দেবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় হয়েছি । বাসায় টিভি ছিল না, এখনও নেই । ২০১১ সালে এক বন্ধু আমাকে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। সেখানেই অনেক আর্টিস্টের খোঁজ পাই। সেখান থেকেই প্রথম আবিষ্কার করি ক্যারিকেচার কি। এরপর থেকে এঁকেই চললাম। সেই সময়টা বিশ্রী রকমের ভয়াবহ, অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী । কিন্তু পাত্তা দেইনি। আঁকাআঁকি করেই গেছি, যাচ্ছিও। এটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার জায়গা।
বললেন, ‘আসলে আমি মনে করি কেউ যদি কোনো কাজে লেগে থাকে সেটা সে পারবেই। এর জন্য লাগে ধৈর্য আর মনোবল। আর এখনকার দিনে আরেকটা জিনিস যোগ হয়েছে, টাকাও থাকতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যদি কেউ আঁকাআকির লাইনে আসতে চায় তাহলে যার অর্থ আছে সেই আসুক। হ্যাঁ, আমি আঁকআঁকি বা ক্যরিকেচার করতে ভালবাসি কিন্তু অর্থের কাছে হেরে যাচ্ছি বারবার।
ক্যারিকেচার বা কার্টুন ভালো লাগার কারণ জানতে চাইলে উত্তর দেন, ‘কার্টুন হলো একটা শক্তিশালী মাধ্যম। যেখানে একটা ঘটনা লিখতে ১০ পৃষ্ঠা লাগবে সেখানে অল্প পরিসরে একটি কার্টুনই যথেষ্ট।’
শিল্পী অসীমের ভালো লাগে ডিজিটাল পেইন্টিং করতে, আড্ডা দিতে, ঘুরে বেড়াতে। আর দুষ্টুমি তো বরাবরের অভ্যাস। আর তিনি অসম্ভব কৃতজ্ঞ তাদের কাছে, যারা তাকে আঁকাআকির ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
অসীম জানালেন, ‘আসলে কৃতজ্ঞতার পাত্র অনেকে। বাইরে থেকে ফেইসবুকবাসী, বন্ধুবান্ধব, দীপ দা, সৌরভ দা, তাওহীদ মিল্টন দা আর পরিবার তো আছেই ‘।
আঁকাআঁকি নিয়ে আছেন এবং থাকতে চান। আছে নতুন নতুন ড্রয়িং টেকনিক শিখার ইচ্ছা । আর এর সবকিছুর আগে ভালো মানুষ হতে চান এই তরুণ শিল্পী।
বিবার্তা/রুবা/মৌসুমী/হুমায়ুন